Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
সাক্ষাত্‌কার

নতুন উপন্যাসে বিভীষণ তারুর থাকছেন?

বিশ শতকের ভারতীয় রাজনীতিকে মহাভারতের আখ্যানের ছকে ফেলে লেখা উপন্যাস ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান নভেল’। জাতীয়তাবাদ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়ে জরুরি অবস্থা, সেই আখ্যান ছুঁয়েছে অনেক কিছুই। এই উপন্যাসের প্রথম প্রকাশের পঁচিশ বছর পূর্ণ হল। প্রকাশিত হয়েছে বইটির এক বিশেষ সংস্করণ। লেখক শশী তারুর-এর একটি একান্ত সাক্ষাত্‌কার।বিশ শতকের ভারতীয় রাজনীতিকে মহাভারতের আখ্যানের ছকে ফেলে লেখা উপন্যাস ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান নভেল’। জাতীয়তাবাদ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়ে জরুরি অবস্থা, সেই আখ্যান ছুঁয়েছে অনেক কিছুই। এই উপন্যাসের প্রথম প্রকাশের পঁচিশ বছর পূর্ণ হল। প্রকাশিত হয়েছে বইটির এক বিশেষ সংস্করণ। লেখক শশী তারুর-এর একটি একান্ত সাক্ষাত্‌কার।

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

জীবনের প্রথম উপন্যাস, গত পঁচিশ বছরে তার চুয়াল্লিশটা সংস্করণ হয়েছে। বইয়ের রজতজয়ন্তী পালিত হচ্ছে। কেমন লাগছে?

আশ্চর্য লাগছে। যখন বইটা লিখছিলাম, তখন এ রকম একটা ভবিষ্যতের কথা স্বভাবতই কল্পনাতেও আসেনি। নতুন লেখকের এমনিতেই হাজারটা দুশ্চিন্তা... বইটা কে ছাপবে, ক’জন পাঠক পড়বে, বইটা কত দিন টিকে থাকবে... কত বই-ই তো বেরোয় আর হারিয়ে যায়। কাজেই, আমি যখন শুনি যে আমার বইটা এত বছর ধরে এত মানুষের মন এবং মেধা ছুঁয়েছে, আজ বইটা পঁচিশ বছর পেরিয়ে এসেও একটা সম্পূর্ণ নতুন প্রজন্মের পাঠকের কাছে পৌঁছোতে পারছে, তাঁরা এই বইটাকে নিজেদের মতো করে পড়তে পারছেন, উপভোগ করছেন, বইটা নিয়ে কথা বলছেন, এটা আমার কাছে একটা অসম্ভব তৃপ্তির বিষয়। জানেন, দু’বছর আগে শুনেছিলাম, এই উপন্যাস নিয়ে নাকি ৭৩টা পিএইচ ডি হয়েছে।

এ রকম একটা উপন্যাস লেখার কথা ভাবলেন কেন?

কোন ধারণা যে কোথা থেকে আসে, ব্যাখ্যা করা মুশকিল। তবে, কোনও একটা নির্দিষ্ট প্রভাবের কথা যদি বলতে হয়, তবে সেটা অধ্যাপক পুরুষোত্তম লালের মহাভারতের ইংরেজি অনুবাদ। সেটা পড়েই আমার মনে হয়েছিল, আমরা এমন একটা সমসাময়িক আখ্যানকে অকারণেই ‘প্রাচীন’ ছাপ দিয়ে সরিয়ে রেখেছি। শেষ বার মহাভারতের কাহিনি লেখা শেষ হয়েছিল চতুর্থ খ্রিষ্টাব্দে। মানে, প্রায় ১৬০০ বছর আগে। আমার মনেই প্রশ্ন এল, কেন আমরা মহাভারতের আখ্যান নতুন করে বলা বন্ধ করে দিলাম? আজ যদি কোনও বেদ ব্যাস তাঁর জীবনকালের গল্প বলতেন— মহাভারতে যেমন বলেছিলেন— তিনি কোন ঘটনার কথা বলতেন? আমার কাছে এই প্রশ্নের একটাই উত্তর— অবশ্যই বিশ শতকের ভারতের ইতিহাস। জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা সংগ্রাম। সেখান থেকেই লেখার সূত্রপাত।

যখন লিখতে আরম্ভ করলেন, তখন আপনি জেনিভায় রাষ্ট্রপুঞ্জের মাঝারি মাপের কর্তা। সেই চাকরিতে খুব বোর হচ্ছিলেন বুঝি?

(হাসি) তখন জেনিভার অফিসে মাঝারি মাপের অফিসার ছিলাম। দায়িত্বও সীমিত। মানে, রাত দশটায় কোনও আন্তর্জাতিক সংকট তৈরি হলে আমার ডাক পড়বে, সে রকম অবস্থা ছিল না। প্রতি দিনই রাত আটটার মধ্যে বাড়িতে ফিরে আসতাম। তার পর লিখতে বসতাম। এই উপন্যাসটা মূলত সন্ধেবেলা আর উইকএন্ডে লেখা। তার পর আর কখনও এ ভাবে নিজস্ব সময় পাইনি। যেমন, যখন যুগোস্লাভ সংকট তৈরি হল, তখন আমি তার দায়িত্বে। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে লিখতে বসার কোনও প্রশ্নই ছিল না। বলতে পারেন, আমার লেখক সত্তার অনিয়মিত উপস্থিতি আমার পেশাদারি জীবনে ব্যস্ততার প্রতিফলন।

লেখাকেই পুরো সময়ের পেশা করার কথা ভাবছেন?

আরে, মাত্র পাঁচ মাস আগে মানুষ আমায় ভোটে জিতিয়ে সংসদে পাঠিয়েছেন। মাঝপথে সেই দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। তবে, এখন যেমন আমি ‘প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী’, জানি এক দিন ‘প্রাক্তন সাংসদ’ও হয়ে যাব। কিন্তু, ‘প্রাক্তন লেখক’ হওয়ার বাসনা নেই!

‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান নভেল’-এর পঁচিশ বছর পেরিয়ে এসে আপনার কি মনে হয়, কোনও বিশেষ চরিত্রের মূল্যায়নে কিছু ভ্রান্তি থেকে গিয়েছে? আপনি কারও প্রতি একটু বেশিই কঠোর হয়েছিলেন, বা কারও প্রতি খানিক অকারণেই সদয়?

যে কোনও লেখার ক্ষেত্রেই, লেখক যখন লেখেন, তাঁর সেই সময়কার সত্যিটাই সত্যি। ষাটের দশকে গার্সিয়া মার্কেস যখন মাকোন্দো নামক জনপদটি সৃষ্টি করছিলেন তাঁর ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড’-এ, তখন তিনি যে প্রেক্ষিত থেকে ইতিহাসকে, রাজনীতিকে দেখেছিলেন, সেই উপন্যাসের ক্ষেত্রে সেটাই সত্যি। তিনি যদি তাঁর জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে উপন্যাসটি লিখতেন, আমি নিশ্চিত, তিনি অন্য ভাবে দেখতেন। যে কোনও সৃষ্টিশীল কাজই স্রষ্টার সেই সময়কার চিন্তাভাবনার প্রতিফলন, সেই সময়ের প্রেক্ষিতে দেখা। আমার উপন্যাসও তাই। সেটা ৩১ বছর বয়সি লেখকের লেখা, যে ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসকে ফিরে দেখছে, তার নিজের বোধের ওপর দাঁড়িয়ে। আজ যদি কেউ এই উপন্যাসটা লিখতেন, জরুরি অবস্থা সম্ভবত তাঁর ক্লাইম্যাক্স হত না। ভারতীয় রাজনৈতিক চেতনা থেকে জরুরি অবস্থার অভিঘাত অনেকটাই মিলিয়ে গেছে এখন। কিন্তু আমাদের প্রজন্মের কাছে সেটাই সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল। আমার উপন্যাসের কুরুক্ষেত্র ছিল জরুরি অবস্থা। প্রত্যেক সময়ের একটা নিজস্ব সত্য থাকে। আমার সময়ের সত্য, আমার কাছে, এটাই ছিল।

কিন্তু, আপনার উপন্যাসে প্রিয়া দুর্যোধনী (‘প্রিয়দর্শিনী’ নামটার সঙ্গে যার মিল একেবারে মোক্ষম) যে ভাবে দ্রৌপদী বা ডি. মোকরাসিকে হেনস্থা করে, সেই আখ্যানটি কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার সময় আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলেনি?

না, কারণ রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগেই আমি আমার অবস্থানটা কংগ্রেস এবং বিরোধী, উভয় পক্ষের কাছেই স্পষ্ট করে নিয়েছিলাম। কেরলে সব রাজনৈতিক জনসভায় একেবারে প্রথম কয়েকটা সারি ভর্তি করে রাখেন বিরোধীরা। চোখা চোখা প্রশ্ন করে বক্তাকে বিপদে ফেলেন। আমার এক সভায় এক সিপিআই কর্মী আমার ‘ইন্ডিয়া: ফ্রম মিডনাইট টু দ্য মিলেনিয়াম’ বইটার মালায়লি অনুবাদ খুলে বেছে বেছে সেই জায়গাগুলো পড়তে থাকলেন, যখানে আমি জরুরি অবস্থা, এবং সেই সময়ে শ্রীমতী গাঁধীর ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছি। উত্তরে আমি বললাম, এই কথাগুলোর একটাও আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমি তো ১৯৭৭ সালের নির্বাচন লড়ছি না। ২০০৯ সালের কংগ্রেস আর জরুরি অবস্থার কংগ্রেস এক নয়। আমার কাছে অন্তত কোনও স্ববিরোধ নেই। অতীত সম্বন্ধে আমার মতামত যাই হোক, সেটা কংগ্রেসের সঙ্গে আমার বর্তমান সম্পর্কে প্রভাব ফেলে না।

আপনি না হয় বুঝলেন, কিন্তু সবাই বুঝবে কথাটা?

ঠিকই। সবাই বোঝে না। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব আমার লেখালেখির কথা সম্পূর্ণ জেনেই আমায় দলে গ্রহণ করেছেন। সনিয়া গাঁধী আমার লেখা অনেক বই পড়েছেন। যখন প্রথম আমায় কংগ্রেসের টিকিট দেওয়ার কথা উঠল, তখন এক জন হতাশ টিকিটপ্রার্থী আমার বইয়ের থেকে অংশবিশেষ ফোটোকপি করে সনিয়া গাঁধীকে পাঠিয়েছিলেন! শীর্ষ নেতৃত্ব পাত্তা দেননি। আমার তো মনে হয়, অতীতকে কী ভাবে অতীতের জায়গাতেই রাখতে হয়, সেটা কংগ্রেসের মাঝারি মাপের নেতাদেরও এ বার শেখা উচিত।

আপনি একাধিক বার বলেছেন, আমরা সবাই আসলে জওহরলাল নেহরুর তৈরি করা ভারতের সন্তান। মনে হচ্ছে না, সেই নেহরু-ঘরানার দিন ফুরোল?

এটা আমারও প্রশ্ন। প্রথম দফার এনডিএ নীতিগত ভাবে ঘোর নেহরু-বিরোধী ছিল। অটলবিহারী বাজপায়ী অবশ্য ব্যক্তিগত ভাবে তা ছিলেন না। আজকের নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্ব ভারতের নেহরু-অনুপ্রাণিত চরিত্রের ওপর দ্বিতীয় দফার ধাক্কা। গত দশ-পনেরো বছরে ভারতের জনসংখ্যায় নবীনদের অনুপাত বেড়েছে, ফলে আশঙ্কা, এই দফার ধাক্কাটা আরও জোরদার হতে পারে। তবে, এটাও মনে রাখার যে নেহরুর জন্মের ১২৫ বছর পালনের কমিটির দায়িত্ব নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদীই। কংগ্রেস এবং বিজেপি-র শীর্ষস্থানীয় নেতারা তো বটেই, দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীরা আছেন। এই কমিটি থেকে কী হবে, সেটা অন্য কথা। কিন্তু মোদীর এই উদ্যোগই বলছে, চান বা না-ই চান, নেহরুকে অস্বীকার করা আজকের ভারতেও অসম্ভব।

ধরুন, কোনও এক লেখক ঠিক করলেন, ভারতের আর এক মহাকাব্য, রামায়ণের গল্পটা আজকের রাজনীতির প্রেক্ষিতে বলবেন। সেই আখ্যানে কি বিভীষণ তারুর নামক একটি চরিত্র থাকবে না?

(হাসি) কী খারাপ! সত্যি, কী খারাপ প্রশ্ন!

সিরিয়াসলি উত্তর দিই। যারা আমায় চেনে, জানে আমি সারা জীবন কোন মূল্যবোধ নিয়ে বেঁচেছি, তারা কখনও ভাববে না যে আমি বিজেপি-তে যোগ দিতে পারি। আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসগুলো স্পষ্ট এবং দৃঢ়। আমি ভারতের বহুত্বে বিশ্বাসী, ভারতীয় সভ্যতার বহুত্বে বিশ্বাসী। আমি আমার বিশ্বাস, মূল্যবোধ নিয়ে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলাম, কংগ্রেসে থেকে আমার মূল্যবোধ তৈরি হয়নি। কাজেই, কাল যদি আমায় কংগ্রেস বহিষ্কারও করে, আমার মূল্যবোধ বদলাবে না। আর, আমার মূল্যবোধগুলো যে গোত্রের, তা নিয়ে বিজেপি-তে স্বচ্ছন্দ হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। কাজেই, বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার প্রশ্নই উঠছে না।

সাক্ষাত্‌কার: অমিতাভ গুপ্ত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE