Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

নাগরিকতন্ত্র

বারাক ওবামা আজ রাজধানীর রাজপথে যে ভারতকে দেখিবেন, তাহা রাষ্ট্রীয় ভারত। প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রদর্শনীতে বিভিন্ন রাজ্যের সাংস্কৃতিক সম্ভার পরিবেশিত হয় বটে, কিন্তু তাহাও প্রবল ভাবে রাষ্ট্রীয় পরিবেশন। বস্তুত, সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ এবং অস্ত্রপ্রদর্শনের চালচিত্রে প্রাদেশিক লোকসংস্কৃতি কী ভাবে রাষ্ট্রপ্রতিমার উপকরণ হইয়া উঠিতে পারে, এই প্রদর্শনী তাহার এক চমৎকার নজির।

শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

বারাক ওবামা আজ রাজধানীর রাজপথে যে ভারতকে দেখিবেন, তাহা রাষ্ট্রীয় ভারত। প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রদর্শনীতে বিভিন্ন রাজ্যের সাংস্কৃতিক সম্ভার পরিবেশিত হয় বটে, কিন্তু তাহাও প্রবল ভাবে রাষ্ট্রীয় পরিবেশন। বস্তুত, সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ এবং অস্ত্রপ্রদর্শনের চালচিত্রে প্রাদেশিক লোকসংস্কৃতি কী ভাবে রাষ্ট্রপ্রতিমার উপকরণ হইয়া উঠিতে পারে, এই প্রদর্শনী তাহার এক চমৎকার নজির। এতদ্দ্বারা ভারতীয় লোকতন্ত্র রাষ্ট্রায়ত্ত হয়। তাহাতে দোষের কিছু নাই, আক্ষেপেরও কোনও কারণ নাই। ভারতীয় রাষ্ট্রের শক্তি এবং সম্মান লোকতন্ত্র হইতেই সঞ্জাত। শত অপূর্ণতা এবং সহস্র ত্রুটি সত্ত্বেও এ দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোটি সবল ও সতেজ, এবং ক্রমাগত নানা ভাবে আপনার সামর্থ্য ঘোষণা করিতে তৎপর। তৃতীয় বিশ্বে আজও এই অভিজ্ঞতা সুলভ নহে। প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারতীয় রাষ্ট্রের আত্মশ্লাঘার কারণ আছে; ভারতীয় লোকসমাজেরও গৌরবের কারণ নাই এমন কথা বলা চলিবে না।

কিন্তু গৌরবের পাশাপাশি গ্লানিও বড় কম নহে। গ্লানি রাষ্ট্রের, নাগরিকেরও। রাষ্ট্রের গ্লানি বহু-আলোচিত। এক দিকে অগণতান্ত্রিক আধিপত্যকামিতার ব্যাধি, অন্য দিকে সর্বজনীন উন্নয়নের যথার্থ ও যথেষ্ট পরিবেশ রচনায় ব্যর্থতা, উভয়তই রাষ্ট্রযন্ত্রের যন্ত্রীরা দায় এড়াইতে পারেন না। কিন্তু দেশ গণতান্ত্রিক বলিয়াই রাষ্ট্রযন্ত্রীদের এই দায়ের ভাগ লোকসমাজও অস্বীকার করিতে পারে না। রাজপুরুষরা যদি রাজধর্ম হইতে বিচ্যুত হন, তবে তাঁহাদের আত্মসংশোধনে বাধ্য করার কাজটি নাগরিকদেরই। সেই কাজ যে তাঁহারা করেন না, এমন নয়। সাম্প্রতিক কালে রাজপুরুষদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিবাদ কার্যত জনজাগরণের রূপ লইয়াছে, ঠিক যেমন জাগরণ দেখা গিয়াছে মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংসার প্রতিরোধেও। উভয় ক্ষেত্রেই এই সামাজিক চাপ রাষ্ট্রশক্তিকে প্রতিকারের আয়োজনে বাধ্য করিয়াছে। আয়োজন যথেষ্ট নহে, কিন্তু প্রাথমিক উদ্যোগটুকুর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই অভিজ্ঞতা যুগপৎ তাহার সাফল্য এবং সীমাবদ্ধতা দিয়াই জানাইয়া দেয় যে, প্রজাতন্ত্র বস্তুটি কোনও অলৌকিক মুক্তিফল নহে। প্রজাতন্ত্র একটি জঙ্গম এবং পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর প্রক্রিয়া, যাহাকে নিরন্তর সজাগ এবং সক্রিয় চেষ্টায় অনুশীলন করিতে হয়। রাষ্ট্রযন্ত্রীরা সেই অনুশীলন পছন্দ করিবেন, এমন নিশ্চয়তা নাই, বরং বিপরীত সম্ভাবনাই প্রবল— পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা তাহাই দেখাইয়া দেয়।

এখানেই নাগরিকের গ্লানি। তাঁহারা প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষায় প্রায়শই আপন দায়িত্ব পালন করেন না। তাঁহারা শাসকের নিকট যথার্থ সুশাসন দাবি করেন না, তাহার পরিবর্তে নানাবিধ প্রলোভনের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। সেই প্রলোভন জাতপাত, ধর্ম, প্রাদেশিকতা বা অন্যবিধ ‘পরিচিতি’র রাজনীতি মারফত আসিতে পারে, ভর্তুকি দিয়া ভোটব্যাঙ্ক কিনিয়া লইবার পাটোয়ারি বুদ্ধির লীলা হইতে পারে, আবার সরকারি কোষাগার হইতে ক্লাবে ক্লাবে টাকা বিলি করিবার নির্লজ্জ এবং নিরাবরণ খয়রাতিও এমনই জনমনোরঞ্জক হইতে পারে যে, নাগরিকরা তাহাতে আহ্লাদিত হইয়া বিপুল দুঃশাসনকেও প্রশ্রয় দিতে পারেন। রাজনীতিকরা এই সকল অন্যায় পথ অনুসরণ করেন, তাহা তাঁহাদের অন্যায়। কিন্তু নাগরিকরা এই অন্যায়কে মানিয়া দেন, তাহা কম গর্হিত নহে। প্রসাদ বিতরণ করিয়া আনুগত্য কিনিবার এই প্রক্রিয়া যে ভারতে, এমনকী ‘রাজনীতিসচেতন’ পশ্চিমবঙ্গেও রীতিমত সফল, তাহা একটি নির্মম সত্য বুঝাইয়া দেয়: ভারতীয় সমাজ এখনও প্রজার সমাজ, নাগরিকের নয়। প্রজা রাজানুগ্রহ পাইয়া ধন্য বোধ করে, নাগরিকের নিকট তাহা অপমানজনক। নাগরিক প্রসাদ চাহেন না, আপন ভাগ্য জয় করিবার অধিকার ও সুযোগ চাহেন। ভারতীয় প্রজাতন্ত্র কবে নাগরিকতন্ত্র হইবে, রাজধানীর রাজপথে অবশ্য সে প্রশ্ন উঠিবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE