Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

না জানিবার ফল

আইনজীবী হিসাবে অরুণ জেটলির যতখানি খ্যাতি, অর্থশাস্ত্রে তাঁহার প্রজ্ঞা ততখানি নহে। কিন্তু তিনি দেশের অর্থমন্ত্রী, অতএব প্রজ্ঞা-নির্বিচারেই মন্তব্য করিবার অধিকারী। জওহরলাল নেহরুর অর্থনৈতিক কাণ্ডজ্ঞানের বিস্তর সমালোচনা করিয়া শ্রীজেটলি সম্প্রতি তাঁহার অধিকারটির মোক্ষম প্রয়োগ করিয়াছেন।

শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

আইনজীবী হিসাবে অরুণ জেটলির যতখানি খ্যাতি, অর্থশাস্ত্রে তাঁহার প্রজ্ঞা ততখানি নহে। কিন্তু তিনি দেশের অর্থমন্ত্রী, অতএব প্রজ্ঞা-নির্বিচারেই মন্তব্য করিবার অধিকারী। জওহরলাল নেহরুর অর্থনৈতিক কাণ্ডজ্ঞানের বিস্তর সমালোচনা করিয়া শ্রীজেটলি সম্প্রতি তাঁহার অধিকারটির মোক্ষম প্রয়োগ করিয়াছেন। নরেন্দ্র মোদী গত দুই বৎসর যাবৎ যাঁহার দীর্ঘ ছায়ার সঙ্গে কুস্তি লড়িতেছেন, তিনি নেহরু। আর, অধুনা ভারতীয় রাজনীতির বীজমন্ত্র হইল চড়া বৃদ্ধির হার। অতএব, নেহরুর কারণেই দীর্ঘ কাল ধরিয়া ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির তলানিতে ছিল, এই মন্তব্যটি এক ঢিলে দুই দৈত্য বধ করিতে পারে— অরুণ জেটলি বা তাঁহার মহানায়ক হয়তো জানেন না, নেহরুকে ‘জেন্টল কলোসাস’ আখ্যা কোনও মোসাহেব দেন নাই, দিয়াছিলেন এক বিরোধী বামপন্থী নেতা, হীরেন মুখোপাধ্যায়। নেহরুর অতিমানবিক অস্তিত্বকে উপলব্ধি করিবার ক্ষমতা সকলের না-ও থাকিতে পারে, কিন্তু অর্থমন্ত্রী যদি রাজনীতির টানে অর্থনীতির প্রাথমিক জ্ঞান বা বোধও বিসর্জন দিয়া বসেন, তবে মুশকিল। নেহরু যখন ভারত গড়িতেছিলেন, তখনও বৃদ্ধির হারের অলিম্পিকস-দৌ়ড় ভারতীয় রাজনীতির সারাৎসার হইয়া উঠে নাই। একটি বিপর্যস্ত দেশকে অর্থনীতির মূলস্রোতে লইয়া আসা তাঁহার লক্ষ্য ছিল। বস্তুত, নেহরু তাঁহার লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন বলিয়াই আজ মোদীরা দশ শতাংশ বৃদ্ধির স্বপ্ন দেখিতে পারেন। কৃতজ্ঞতা দুর্বলের ধর্ম নহে। নচেৎ, আজিকার নেতাদের নিকট নেহরু ধন্যবাদার্হ হইতেন।

নেহরুর নিকট উন্নয়ন শুধুমাত্র কিছু সংখ্যার দৌড় ছিল না। তাহা ছিল আধুনিকতার প্রকল্প। বাঁধকে আধুনিক ভারতের মন্দির-মসজিদ বলিয়া ভাবিতে পারিবার মধ্যে যে ভবিষ্যৎমুখিতা ছিল, তাহা সম্ভবত জেটলিদের কল্পনাতীত। ভারতের সদ্যোলব্ধ স্বাধীনতাকে বাঁচাইয়া রাখিতে হইলে যে পশ্চিমি দুনিয়ার উন্নত দেশগুলির মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিলে চলিবে না, এই কথাটি নেহরু বুঝিয়াছিলেন। ফলে, তিনি রাষ্ট্রকে যে শিল্পায়নের পথে লইয়া গিয়াছিলেন, তাহা মূলধনী পণ্য উৎপাদনের পথ। তাঁহার নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্র ইস্পাত, রাসায়নিক, সিমেন্ট, গাড়ি-রেল-বিমান নির্মাণ ইত্যাদিতে মন দিয়াছিল। এই পথে হাঁটিবার অর্থ ভোগ্যপণ্যের গুরুত্ব হ্রাস। স্বল্পমেয়াদে যেমন সাধারণ মানুষের ভোগের কম সুযোগ, তেমনই বৃদ্ধির হারের গতিশীলতাও কম থাকা। তিনি ভবিষ্যতের স্বার্থে বর্তমানকে বঞ্চিত করিয়াছিলেন। সেই ভবিষ্যতের স্বার্থে, যখন তাঁহার প্রজন্মের ত্যাগস্বীকারের সম্পূর্ণ সুফল নিঃশেষে গ্রহণ করিবার পর তাঁহার অর্থনৈতিক প্রজ্ঞাকে তীব্র আক্রমণ করা হইবে। অরুণ জেটলিদের দোষ নহে, অন্ধের হস্তিদর্শন সম্পূর্ণ না হওয়াই স্বাভাবিক।

আরও এক প্রধানমন্ত্রী বর্তমানের নিকট কৃতজ্ঞতা দাবি করিতে পারেন। রাজীব গাঁধী। তাঁহার চিন্তা ও চেষ্টায় অনেক ভুল ভ্রান্তি ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু একবিংশ শতকের বিশ্ব অর্থনীতির চেহারা কী হইবে, এবং সেই মঞ্চে নিজের আসন করিয়া লইতে হইলে ভারতকে কোন পথে হাঁটিতে হইবে, তাহা দেখিবার একটি উদ্যোগ তিনি করিয়াছিলেন। রাজনীতিতে ‘বহিরাগত’ ছিলেন বলিয়াই হয়তো আর এক বহিরাগত স্যাম পিত্রোদার হাতে টেলিকম বিপ্লবের গুরুদায়িত্ব সঁপিয়া দিতে পারিয়াছিলেন। যে তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিকমিউনিকেশনের জোড়া ঘোড়া ভারতীয় অর্থনীতির রথ টানিয়া লইয়া যাইতেছে, উভয়ের পিছনেই রাজীব গাঁধীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাঁহার এই অবদানের উল্লেখ হয় না বলিলেই চলে। কংগ্রেসও এই রাজীবকে ভুলিয়াছে। অরুণ জেটলিরা নেহরুর প্রতিই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিয়া উঠিতে পারেন না, অতএব রাজীবের কথা আর না তোলাই বোধ হয় ভাল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE