বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পারিয়াছিলেন। সূর্যকান্ত মিশ্র না পারিবার পণ করিয়াছেন। ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে তাঁহার সহিত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নমস্কার বিনিময়ের ছবিটি সাম্প্রতিক বঙ্গ-রাজনীতিতে সৌজন্যের বিরল নিদর্শন হইয়া আছে। প্রশ্নটি অবশ্য শুধু সৌজন্যের নহে। তাহা গভীরতর। নূতন সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকিলে শুধু সেই সরকারের প্রতিই অনাস্থা প্রকাশ পায় না, তাহা গণতন্ত্রের প্রতি অনাস্থার দ্যোতক। মানুষের রায়ে যে সরকার গঠিত হইতেছে, তাহার সূচনার লগ্নটিকে এড়াইয়া যাওয়ার অর্থ, মানুষের রায়কে অসম্মান করা। সূর্যকান্ত মিশ্র-অধীর চৌধুরীরা বঙ্গবাসীর রায়কে অসম্মান করিতেই মনস্থ করিয়াছেন। বিজেপি এখনও মনস্থির করিয়া উঠিতে পারে নাই। আশা করা যাউক, দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকিবার পক্ষেই রায় দিবে। তাহাতে রাজ্যের সম্মান খানিক হইলেও বাঁচিবে। কারণ, বিরোধীরা শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান বয়কট করিলে তাহাতে শুধু শাসক দলের পক্ষে যাওয়া জনাদেশেরই অপমান হয় না, তাঁহাদের পক্ষে আসা জনাদেশেরও সমান অপমান। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যে মানুষরা তাঁহাদের ভোট দিয়াছেন, তাঁহারা একই সঙ্গে একটি দায়িত্বও দিয়াছেন— গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসক দলের বিরোধিতা করা। সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিসর হইতে পলাইয়া সেই দায়িত্ব পালন অসম্ভব। তাহার জন্য উপস্থিত থাকিতে হইবে, সরকার পক্ষের সহিত আলোচনায়-তর্কে-মতান্তরে সংযুক্ত হইতে হইবে। বয়কটের সিদ্ধান্ত করিয়া বিরোধীরা এই জনাদেশেরও সমান অপমান করিতেছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসন (অথবা শাসনহীনতা) লইয়া বিরোধীদের অভিযোগ প্রচুর। তাহার সবটাই যে অসঙ্গত, এমন দাবি করিবারও কোনও কারণ নাই। নির্বাচন-পরবর্তী সন্ত্রাস চলিতেছে। পুলিশের নিকট যে সক্রিয়তা প্রত্যাশিত, তাহা পাওয়া যায় নাই। বিরোধীরা তাহার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকেই দায়ী ঠাওরাইলে তাঁহাদের দোষ দেওয়া মুশকিল। রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হইলে তাহার প্রতিবাদ করা বিরোধীদের কর্তব্য। সরকারের নিকট জবাবদিহি দাবি করাও। কিন্তু, তাহার জন্য শপথগ্রহণের অনুষ্ঠান বয়কট করিতে হয় না। বরং, আরও বেশি করিয়া গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শামিল হইতে হয়, আরও বেশি সরকারের সহিত সংযুক্ত হইতে হয়। সত্য, শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকিবার কোনও আইনি বাধ্যবাধকতা নাই। কিন্তু, তাহা অনৈতিক। তাহার অর্থ এই সংকেত দেওয়া যে, ১৯ তারিখ ভোটগণনা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গণতন্ত্রেরও পাট উঠিয়াছে, ভোটের খেলায় জয়ী না হইতে পারিলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সহিত আর কোনও সম্পর্ক রাখাকে বিরোধীরা নেহাত বাহুল্য জ্ঞান করেন।
এই দোষে শুধু বঙ্গজ বিরোধীরাই দুষ্ট নহেন। গত এক দশককাল ভারতীয় সংসদে বিরোধীদের ভূমিকা দেখিলে বোঝা যায়, বিরোধীর দায়িত্ব সম্বন্ধে কোনও ধারণা এই দেশে গড়িয়া উঠে নাই। গণতন্ত্র শুধু শাসকের নহে। বস্তুত, তাহা শাসকের যতখানি, বিরোধীদেরও ততখানিই। শাসক সিদ্ধান্ত করিবেন, বিরোধীরা সেই সিদ্ধান্তের নৈতিকতা, যাথার্থ্যকে প্রশ্ন করিবেন। এই বিনিময়ের মাধ্যমেই গণতন্ত্র গতিশীল হয়। বিরোধীর ভূমিকা, প্রকৃত প্রস্তাবে, গণতন্ত্রের বিবেকের। শাসককে নিজের কর্তব্যের কথা, রাজধর্মে অবিচল থাকিবার কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়াই বিরোধীদের কাজ। কিন্তু, তাহার জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশী হইতে হয়। জল-অচল সম্পর্কের সস্তা রাজনীতি নহে, শাসকের সহিত যত বেশি সম্ভব আদানপ্রদানের মাধ্যমেই বিরোধীরা এই দায়িত্ব পালন করিতে পারেন। কিন্তু, তাহার জন্য হাততালির মোহ ছাড়িতে হয়। সূর্যকান্ত মিশ্ররা তাহা পারিবেন কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy