অবশেষে অসমে বসবাসকারী বাংলাভাষী শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব মিলিবার আশা জাগিয়াছে। এই শরণার্থীরা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান হইতে অসমে আশ্রয় লন মূলত ধর্মীয় নির্যাতন ও সামাজিক-রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার হইয়া। ক্রমে এই শরণার্থীদের ‘বিদেশি নাগরিক’ রূপে চিহ্নিত করিয়া তাহাদের বিতাড়নের জন্য তুমুল আন্দোলন শুরু হয়। এক সময় আন্দোলন বাঙালি শরণার্থীদের গণহত্যায় রূপান্তরিত হয়। অতঃপর আন্দোলনকারীদের সহিত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী সরকারের ‘অসম চুক্তি’, যাহার শর্তই ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর অসমে প্রবেশকারীদের ‘বিদেশি’ শনাক্ত করিয়া ক্রমান্বয়ে তাহাদের বহিষ্কার, কিন্তু তাহার আগে যাঁহারা এই রাজ্যে আসিয়াছেন, তাঁহাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দান। এত দিনে অসমের নির্বাচিত রাজ্য সরকার এই প্রতিশ্রুতি পালনে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত লইয়াছে।
শরণার্থীদের সংখ্যা লইয়া কোনও আদমসুমারি নাই। তবে বিভিন্ন সমীক্ষায় তাঁহাদের সংখ্যা আনুমানিক ৮৫ লক্ষ বলিয়া জানা গিয়াছে। পূর্ব-পাকিস্তানে নিগ্রহের শিকার হইয়াই তাঁহারা অসমে প্রবেশ করেন। চার দশকের বেশি সময় ধরিয়া তাঁহারা কার্যত নাগরিকত্ব হইতে বঞ্চিত। ফলে বিবিধ নাগরিক অধিকার এত কাল তাঁহারা পান নাই। উপরন্তু সর্বদাই বিতাড়িত হওয়ার আশঙ্কা তাঁহাদের দৈনন্দিন জীবনকে সমূহ অনিশ্চয়তা ও গ্লানির মধ্যে ফেলিয়া রাখিয়াছে। একই ভাবে ভারতের পশ্চিম সীমান্তে গুজরাত ও রাজস্থান প্রদেশে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে আগত শরণার্থীরা কিন্তু অনেক আগেই ভারতীয় নাগরিকত্ব পাইয়া গিয়াছেন। অসমের বঙ্গভাষী শরণার্থীদের সেই সৌভাগ্য হয় নাই। কেন্দ্রে বিজেপির সরকার কায়েম হওয়ায় যে অসম সরকারের পক্ষে তাঁহাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত লইতে সুবিধা হইয়াছে, তাহাতে সংশয় নাই। প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী রূপে নরেন্দ্র মোদী তাঁহার নির্বাচনী প্রচারপর্বেই এই শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দানের আশ্বাস দিয়াছিলেন। তিনি অনুপ্রবেশকারীদের সহিত শরণার্থীদের ভেদরেখা টানিয়া বিষয়টি স্পষ্ট করিয়াছিলেন। অসমে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন তরুণ গগৈ সরকার যে নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে অভিষেকের সুযোগ লইয়াই মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত লইতে পারিয়াছেন, তাহাতে সন্দেহ নাই।
অসম একা অবশ্য শরণার্থীদের এই বঞ্চনার লীলাভূমি নয়, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা সহ উত্তরপূর্বাঞ্চলের সব রাজ্যেই কমবেশি শরণার্থীস্রোত আসিয়াছে। কিন্তু অন্যান্য রাজ্যে বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলন হয় নাই। শরণার্থী ও অনুপ্রবেশকারী, উভয়েই রাজ্যগুলির জনসমাজে মিশিয়া গিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যে রাজ্যের অন্যান্য জেলার তুলনায় অধিক, তাহাতেই এই ঘটনার প্রমাণ। এই সব জেলায় জনবিন্যাসের সাম্প্রদায়িক কাঠামোও বিপুল ভাবে পরিবর্তিত। অর্থনৈতিক কারণও অনেক বহিরাগতকে সীমান্ত অতিক্রম করিতে প্রলুব্ধ করিয়াছে। রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের ভোটার বাড়াইবার সংকীর্ণ তাগিদে এই বহিরাগতদের সকলকেই রেশন কার্ড, সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র করাইয়া দিয়াছেন। প্রতিবেশী দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা যত বাড়িবে, ততই সীমান্ত রাজ্যগুলিতে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বাড়িবে। তাই এই রাজ্যগুলিতেও নাগরিকত্ব প্রাপ্তির ভিত্তি হিসাবে অনুপ্রবেশের একটা সময়সীমা ধার্য হওয়া উচিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy