অভিনেতা আমির খান ভারতের ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা প্রসঙ্গে কিছু কথা বলিয়াছেন। কেন বলিয়াছেন, তাঁহার কথার সারবত্তা কতখানি, প্রশ্নগুলি গৌণ। সেই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় রাজনীতির পরিসরে, সোশাল মিডিয়ায় ও অন্যত্র যে ঝড় উঠিয়াছে, এক্ষণে তাহাই লক্ষণীয়। প্রতিক্রিয়াগুলি চরিত্রে অসহিষ্ণু। অসহিষ্ণুতা অপরিণতমনস্কতার লক্ষণ। স্পষ্টতই, ভারতীয় গণতন্ত্র এখনও নাবালক। দেশপ্রেমের প্রসঙ্গ উঠিলেই সেই নাবালকের উত্তেজনাও বাড়ে, ফলে যাহাতে নিস্পৃহ থাকাই বিধেয়, তাহাতেও প্রতিক্রিয়ার বন্যা বহিয়া যায়। গণতন্ত্র পরিণতমনস্ক হইলে তাহার চেহারা কী রকম হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাহার উদাহরণ। ইউক্রেনের ইহুদি উদ্বাস্তু পিতার সন্তান নোম চমস্কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভূমিপুত্র’ নহেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ইস্তক মার্কিন বিদেশনীতির যে কড়া সমালোচনা তাঁহার মুখ এবং কলম হইতে বাহির হইয়াছে, তাহা হজম করা সহজ নহে। মার্কিন সমাজ যে তাঁহার সহিত একমত হইয়াছে, তাহাও নহে। কিন্তু কেহ তাঁহাকে হেনস্তা করিতে পথে নামিয়া পড়েন নাই, দেশপ্রেমের পাঠ পড়াইতে উদ্যত হন নাই। শুধু চমস্কিই নহে, মার্কিন মাটিতে সেই দেশের, সমাজের, এমনকী সামরিক নীতির সুতীব্র সমালোচনা করিয়াও অনেকেই বহাল তবিয়তে আছেন। সেই দেশে জাতীয় পতাকার রঙে রঞ্জিত অন্তর্বাসও দেদার বিক্রয় হয়। তাহাতে কাহারও দেশপ্রেমের অভিমানে আঘাত লাগে না। গণতন্ত্র পরিণত হইলে এমনটাই হওয়ার কথা।
জর্জ বার্নার্ড শ’ বলিয়াছিলেন, কোনও একটি দেশে আমি জন্মিয়াছি বলিয়াই দেশটি দুনিয়ার সেরা, এই বিশ্বাসের নামই দেশপ্রেম! আশঙ্কা হয়, ভারতের একশত পঁচিশ কোটি মানুষের অধিকাংশই এমন অলীক বিশ্বাসের দ্বারা চালিত। ফলে, দেশপ্রেমের আবেগে যখন-তখন আঘাত লাগে। কোনও ন্যায্য সমালোচনাও সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য হইয়া উঠে। সমালোচনার যে একটি গঠনমূলক দিক আছে, এবং দেশের অন্ধকার দিকগুলি দেখাইয়া তাহার সংশোধনের পথে হাঁটিবার কথা বলাই যে প্রকৃত দেশপ্রেমিকের কাজ, এই কথাটি নাবালক গণতন্ত্রে স্বভাবতই কলিকা পায় না। ইদানীংকালে বিশেষত মোদীভক্তদের মধ্যে তর্কের একটি আঙ্গিক বিশেষ জনপ্রিয় হইয়াছে— কোনও প্রশ্ন উঠিলে তাহার উত্তরে ‘উহাদের বেলায় কী বলিবেন?’ মর্মে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়িয়া দেওয়া। ভারতই যে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ, তাহা প্রমাণ করিতেও এই আঙ্গিকে তর্ক হয়। যেমন, ভারত যদি অসহিষ্ণু হয়, তবে আইএস-এর জঙ্গিদের কী বলিবেন? যেন আইএস-ই সহনশীলতার মাপকাঠি! তর্কের এই স্তর বলিয়া দেয়, ভারতমাতাকে লইয়া গর্বে যাঁহাদের ছাতি ছাপ্পান্ন ইঞ্চি হইতেছে, তাহাদের লইয়া গর্বিত হওয়ার কোনও কারণ ভারতমাতার নাই।
দেশবাসীর অধিকাংশই অপরিণতমনস্ক হইলে গুরুতর বিপদ— তাহাদের মতে যাহা দেশপ্রেম, তাহাকেই দেশপ্রেমের একমাত্র সংজ্ঞা হিসাবে মানিয়া লইতে আর কোনও বাধা থাকে না। গণতন্ত্র যখন, তখন সংখ্যাগরিষ্ঠের মতই একমাত্র হইবে, আশ্চর্য কী? ফলে, যাঁহারা ভিন্নতর সংজ্ঞায় বিশ্বাসী, যাঁহাদের স্বাধীন চিন্তাশক্তি আছে, তাঁহাদের দেশপ্রেম লইয়া প্রশ্ন তোলাও সহজ হয়। এমনকী, তাঁহাদের দেশদ্রোহী বলিয়া দাগাইয়া দিতেও সমস্যা নাই। কাহাকে কেন দেশপ্রেমী হইতেই হইবে, নাবালকের গণতন্ত্রে এমন প্রশ্নের কোনও ক্ষমা নাই। অথবা, দেশপ্রেমী হইতে হইলে কেন অন্য রাষ্ট্রের প্রতি অসূয়া পোষণ করিতে হইবে, এমন প্রশ্নও নাবালকের গণতন্ত্রে নিষিদ্ধ। এই অসহিষ্ণু একদেশদর্শিতা আর যাহাই হউক, প্রকৃত গণতান্ত্রিক বোধের পরিচায়ক নহে। দেশপ্রেমে দোষ নাই, কিন্তু একমাত্রিক দেশপ্রেমকেই সকলের গলায় ঢালিয়া দেওয়ার চেষ্টা অতি বিপজ্জনক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy