Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

নৈরাজ্যের পিছনে

গাঁধীর গুজরাতও যে দ্রুততায় আন্দোলন সংগঠন করিতে পারে নাই, হার্দিক পটেলের গুজরাত তাহা করিয়া দেখাইল। শুধু নবতর ও উন্নততর সংযোগমাধ্যম, সামাজিক নেটওয়ার্কিং-এর প্রসার দিয়াই এই দ্রুততার ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রীর রাজ্য জুড়িয়া এই মুহূর্তে যে অশান্তির আগুন, তাহার ভিতর সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিক্ষোভের লেলিহান শিখা সাদা চোখেই দেখা যায়।

শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

গাঁধীর গুজরাতও যে দ্রুততায় আন্দোলন সংগঠন করিতে পারে নাই, হার্দিক পটেলের গুজরাত তাহা করিয়া দেখাইল। শুধু নবতর ও উন্নততর সংযোগমাধ্যম, সামাজিক নেটওয়ার্কিং-এর প্রসার দিয়াই এই দ্রুততার ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রীর রাজ্য জুড়িয়া এই মুহূর্তে যে অশান্তির আগুন, তাহার ভিতর সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিক্ষোভের লেলিহান শিখা সাদা চোখেই দেখা যায়। এই বিক্ষোভ একটি কথাই প্রমাণ করে। সংরক্ষণের মতো এত প্রবল সামাজিক বিভাজনের শক্তি সম্ভবত কোনও সরকারি নীতি বা প্রকল্পেই নাই। আড়াই দশক আগে মণ্ডল কমিশনের প্রশ্নেও ইহা বুঝা গিয়াছিল, আজকের হার্দিক পটেলের আন্দোলনও তাহা চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিতেছে। গুজরাতের পটেলরা সমাজের সম্পন্ন গোষ্ঠী, তাহাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উচ্চাশাও ইতিহাসের সাধারণ গতিতেই বাড়িয়া গিয়াছে। এ দিকে সম্পন্নতার ফাঁকেফোকরে এই গোষ্ঠীর যে সব সদস্য দারিদ্র কিংবা পশ্চাৎপদতার কোটরে পড়িয়া রহিয়াছেন, তাঁহাদের জীবন আরও কঠিন করিয়া দিয়াছে সংরক্ষণের শতাংশ-হিসাব। তাঁহারা এখন সংরক্ষণের ভাষাতেই সংরক্ষণের বিরোধিতায় নামিয়াছেন, নিজেদের পরিস্থিতির নিরাময় চাহিতেছেন। একুশ বছর বয়সী ‘জননেতা’ হার্দিক এই উচ্চজাতি-সম্ভূত ক্ষুব্ধ তরুণ সমাজের নূতন উচ্চাশা ও সম্পন্নতার চাহিদারই প্রতিভূ।

স্বাধীন ভারতের সূচনায় সংরক্ষণ ছিল ঐতিহাসিক ভাবে অনুন্নত, পশ্চাৎবর্তী সমাজগুলির প্রতি উদ্দিষ্ট: উন্নয়নের আলোকবৃত্তে যাহারা পা দিবারই সুযোগ পায় নাই, তাহাদের জন্য সুযোগ তৈরি করিবার নীতি। ভারতের জাতিভেদ-অধ্যুষিত কট্টর অসাম্যের দুনিয়ায় তখন এই নীতি স্বভাবতই অতি সদর্থক, প্রগতিশীল হিসাবে গণ্য হইবার যোগ্য ছিল। পরবর্তী কালে সংরক্ষণের মঞ্চ যেই ক্রমবর্ধমান দাবির সঙ্গে পাল্লা দিয়া আকারে-প্রকারে বাড়িতে লাগিল, ‘অন্যান্য অনগ্রসর জাতি’র তকমায় অর্থনৈতিক ভাবে যথেষ্ট সম্পন্ন কিন্তু সামাজিক পরিচয়ে পশ্চাদপর গোষ্ঠীগুলির সংরক্ষণ-মঞ্চে হুড়মুড় করিয়া প্রবেশ ঘটিল, তখন হইতেই সংরক্ষণের অ্যাজেন্ডাটি হাইজ্যাক করা হইল। সদর্থক প্রগতির বদলে তাহা হইয়া দাঁড়াইল পারস্পরিক বিরোধিতার মাধ্যমে সামাজিক অধোগতির সোপান। সংরক্ষণ এখন আর অনগ্রসর নাগরিকের সহায়তার্থে আগাইয়া দেওয়া ক্রাচ নহে, বরং শ্রেণি-জাতি-গোষ্ঠীভেদে বহুবিভক্ত বহুদীর্ণ সমাজের মধ্যে পারস্পরিক আঘাত-প্রত্যাঘাতের অস্ত্র। সংরক্ষণ নীতির এই পরিবর্তিত প্রাসঙ্গিকতার দিকে নজর না দিলে কেবল গুজরাতে নয়, অন্যাত্রও হার্দিকরা নৈরাজ্য তৈরি করিতে পারেন।

প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁহার স্বপ্নের গুজরাতের ছবিটি ভোট-বাজারে বেচিয়াই শীর্ষ-ক্ষমতায় আসিয়াছেন। উন্নয়নের সেই গল্পটিও যে পুরাদস্তুর স্বপ্নসম ছিল না, এই অভিযোগ সে দিন অনেকেই করিয়াছিলেন। অভিযোগটি যে ফেলনা ছিল না, এই আন্দোলন তাহারও প্রমাণ। বিশেষ কিছু শ্রেণি বা সমাজের মধ্যেই সেই উন্নয়নের রথযাত্রা সীমিত ছিল। উন্নয়ন পরিকল্পনা ও তাহার প্রণয়নের মধ্যেও তীব্র একদেশদর্শিতা ছিল, উৎপাদন শিল্পের ধারকাছে আসিতে পারে নাই পরিষেবা ও অন্যান্য সামাজিক ক্ষেত্রগুলি। ফলে এক বিরাট অংশের নাগরিক জনসমাজ ক্রমেই উপযুক্ত ও উন্নত জীবিকানির্বাহের সন্ধানে অসফল হইতে থাকেন। হার্দিক পটেল সেই অসফল গুজরাতি নাগরিকদের নেতা। ভ্রান্ত উন্নয়ন নীতি শুধু অর্থনীতিকেই শেষ পর্যন্ত ব্যাহত করে না, সমাজকেও ছিন্নভিন্ন করে। ২০০২ সালের গুজরাত তাহা এক দিক হইতে প্রমাণ করিয়াছিল, ২০১৫-র গুজরাত আর এক দিক হইতে করিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE