Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

নির্বাচনতন্ত্র

গণতন্ত্রের দুনিয়ায় তাহার ভারতীয় অবতার একটি নূতন অভিজ্ঞতার জ্ঞাপক। সেই অভিজ্ঞতার নাম নির্বাচনতন্ত্র। ভোটের বাক্স ইহার এক ও একমাত্র উদ্দেশ্য এবং বিধেয়। ক্ষমতা কী ভাবে ভাগাভাগি হইবে, কে কাহার পক্ষে বা বিপক্ষে দাঁড়াইবেন, এই সব প্রশ্নের চুলচেরা হিসাবের নামই গণতন্ত্রের পরিসর।

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

গণতন্ত্রের দুনিয়ায় তাহার ভারতীয় অবতার একটি নূতন অভিজ্ঞতার জ্ঞাপক। সেই অভিজ্ঞতার নাম নির্বাচনতন্ত্র। ভোটের বাক্স ইহার এক ও একমাত্র উদ্দেশ্য এবং বিধেয়। ক্ষমতা কী ভাবে ভাগাভাগি হইবে, কে কাহার পক্ষে বা বিপক্ষে দাঁড়াইবেন, এই সব প্রশ্নের চুলচেরা হিসাবের নামই গণতন্ত্রের পরিসর। রাজনৈতিক দলগুলি এই পরিসরেই গঠিত ও সংগঠিত হয়। মানুষ তাহাদের মধ্যে সমর্থন বাঁটোয়ারা করিয়া দেন। আদর্শ, লক্ষ্য, নীতি, কার্যক্রম ইত্যাদি অন্যান্য অলীকতা এই অভিজ্ঞতায় অবান্তর। সম্প্রতি বিহার এই সত্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। নির্বাচন কমিশন বিধানসভা নির্বাচনের সময় ঘোষণা করিতেই উদ্ভূত হইল একটি আনকোরা নূতন আঞ্চলিক দল। জানা গেল, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ভোটে লড়িবে এই জনক্রান্তি অধিকার মোর্চা, যাহার সর্বময় নেতা, লোকসভার সাংসদ, বহিষ্কৃত আরজেডি নেতা রাজেশ রঞ্জন ওরফে পাপ্পু যাদব। দলের জন্ম দিয়াই তিনি অকাতরে জানাইয়া দিলেন যে আসন্ন নির্বাচনে বিহাের তৃতীয় ফ্রন্ট হিসাবে ল়ড়িবার জন্যই এই দলের উৎপত্তি। এখনও দুই মাস আগে সঞ্জাত নবজাতক দল, জেডি(ইউ)-এর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বহিষ্কৃত সদস্য জিতনরাম মাঁজির বিক্ষুব্ধ দল হিন্দুস্থান আওয়ামি মোর্চার আঁতুড় ফুরায় নাই, নূতন জাতক হাজির। পাপ্পু যাদব জিতনরামের সহিত হাত মিলাইয়া ভোটে লড়িবার কথা ভাবিতেছেন। সম্ভবত কংগ্রেসের সহিতও।

এ যাবৎ বিহারের ভোটচিত্রে ছিল এক দিকে নীতীশকুমার-লালুপ্রসাদের যুগ্ম ফ্রন্ট, অন্য দিকে ভারতীয় জনতা পার্টি। এক পক্ষের ভাণ্ডারে ‘নিচু জাত’-এর ভোট, অন্য পক্ষের ভরসা জাত-রাজনীতিতে তিতিবিরক্ত তামাম ‘উচ্চ জাত’-এর সমাজ। নূতন নেতাদের আশা, এই দুই পক্ষেরই ভোটব্যাঙ্কে ধস নামাইয়া তাঁহারা বাজিমাত করিবেন। অনগ্রসর জাতির ভোট টানিতে মাঠে নামিবেন লালুপ্রসাদের প্রাক্তন সহকর্মী পাপ্পু যাদব। মহাদলিত ভোটের হিসাবে গোল পাকাইতে আসরে হাজির হইবেন নীতীশকুমারের স্বহস্তনির্বাচিত এবং স্বহস্তবিসর্জিত ‘মুখ্যমন্ত্রী’, আপাতত তাঁহার অগ্নিখাদক প্রতিপক্ষ জিতনরাম। সংখ্যার যে খেলায় তাঁহাকে পর্যুদস্ত করা হইয়াছে, এ বার সেই সংখ্যার উলটপুরাণ ঘটাইয়াই তিনি ‘গণতন্ত্র’-এর মহিমা বুঝাইবেন।

এই নির্মীয়মাণ যুদ্ধাঙ্গনে নীতিগত বা আদর্শগত বাক্যালাপের বালাই নাই। সবটাই (অবি)নির্মিত হইতেছে ক্ষমতার প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির হিসাবে। জাত-রাজনীতিই প্রধান প্রেক্ষিত, কিন্তু ক্ষমতার টানাপড়েন জাত-রশিকেও ঢিলা করিয়া দেয়। যে অনগ্রসররা এক দিন এক মেরুতে উজাড় করিয়া ভোট ঢালিয়াছিলেন, তাঁহারাই আজ অন্য প্রতিপক্ষের মুখাপেক্ষী হইবেন। নীতীশকুমার লালুপ্রসাদরা যতই ভাবুন নিচু জাতের সমাহার ঘটাইতে চাহেন, বিজেপি যতই সকল উচ্চবর্ণীয় হিন্দু ভোট একাই পকেটস্থ করিবার আশা করুক, নির্বাচনী-পূর্ব আঁতাতগুলিতে ক্ষমতার নববিন্যাসই শেষ কথা বলিবে। আইডেন্টিটি-চালিত ভোটের সরলরৈখিক পথকে ভাঙিবে-চুরিবে। কেবল বিহারে নয়, দেশের অন্যত্রও আইডেন্টিটির রাজনীতি এই ভাবেই রকেট-বাজির মতো কিছু দূর দ্রুত বেগে উঠিয়া সমধিক দ্রুত বেগে নীচের দিকে নামিয়া আসিয়াছে। ক্ষমতার প্রশ্নে নেতৃত্ব বিভক্ত হইয়াছে, নেতৃত্বের সঙ্গে সমর্থন ভাগাভাগি হইয়াছে। ক্ষমতার রাজনীতির উদগ্রতার সামনে আইডেন্টিটির বর্ণমালা পরাভূত। বিহারের আসন্ন নির্বাচনও তাহার আর একটি ‘কেস-স্টাডি’ হইবার অপেক্ষায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE