আইন বানাইতে, কমিটি তৈরি করিয়া সুপারিশ করিতে লোকের অভাব নাই। কিন্তু আইন কিংবা সুপারিশ কাজে পরিণত করিবে কে? নির্ভয়া কাণ্ডের পাঁচ বৎসর কাটিল। রাজধানীর রাস্তায় যে কলেজছাত্রী গণধর্ষণে প্রাণ হারাইয়াছিল, তাহার কথা দেশ ভোলে নাই। প্রতি বৎসর ১৬ ডিসেম্বর তাই হিসাব তলব করা হয়, যৌন নির্যাতনের প্রতিরোধ করিতে দেশ কতটা তৎপর হইল? নির্যাতিত মেয়েরা কতটা সহায়তা পাইয়াছে? তখনই স্পষ্ট হয়, নির্দেশ দিবার, প্রস্তাবের তালিকা পেশ করিতে যত উৎসাহ, কাজ করিতে তত নাই। নির্ভয়া কাণ্ডের জেরে জনসমাজে মেয়েদের নিরাপত্তা রক্ষায় প্রশাসনের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ দেখা গিয়াছিল, তাহা প্রশমিত করিতে আইন বদল করিয়া ধর্ষণের সংজ্ঞা ও শাস্তি বদল করিয়া আরও কড়া করা হইয়াছে। নির্যাতিতাদের নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও আইনি পরামর্শের জন্য ‘নির্ভয়া তহবিল’ গঠন করা হইয়াছে। সেই তহবিল হইতে ধর্ষিতাদের ক্ষতিপূরণ মিলিবার কথা। দুই মাসের মধ্যে ধর্ষণের মামলার নিষ্পত্তি করিবার সুপারিশ করা হইয়াছে আইনে। কিন্তু এতগুলি অঙ্গীকারের ফল কী হইয়াছে? দিল্লিসহ মহানগরগুলি মহিলাদের জন্য সুরক্ষিত হইয়াছে, এমন ইঙ্গিত মেলে নাই। অধিকাংশ হাসপাতালে সহায়তা কেন্দ্রগুলি চালু হয় নাই, যেখানে হইয়াছে সেখানেও তাহা তালাবন্ধ অবস্থাতেই থাকে।
অনেক সমালোচিত হইয়া নির্ভয়া তহবিলে আড়াইশো কোটি টাকা বরাদ্দ করিয়াছে কেন্দ্র, যাহা নির্ধারিত অঙ্কের দশ শতাংশও নহে। বহু ধর্ষিতার নিকট আজও ক্ষতিপূরণ পৌঁছায় নাই, তাই তহবিল কতটা ব্যবহৃত হইতেছে সে প্রশ্নও থাকিয়া যায়। সর্বোপরি, নির্যাতিতাদের প্রতি পুলিশ-প্রশাসনের সহমর্মিতাও বাড়ে নাই। সমীক্ষায় প্রকাশ, এখনও ধর্ষিতা মেয়েরা থানায় অভিযোগ করিতে গেলে কটূক্তি এবং তাচ্ছিল্যের সম্মুখীন হইয়া থাকেন। অভিযোগ নিতে টালবাহানা করিলে পুলিশকর্মীদের আইনত শাস্তি হইবার কথা। কিন্তু তেমন দৃষ্টান্ত আজ অবধি সম্মুখে আসে নাই। নানা রাজ্যে নানা স্তরের আদালতে বিচারাধীন ধর্ষণের মামলার সংখ্যা এক লক্ষ আঠারো হাজার।
‘নির্ভয়া’ উত্তরপ্রদেশ হইতে দিল্লিতে আসিয়া পেশাদারি প্রশিক্ষণ লইতেছিলেন। তাঁহাদের মতো ছাত্রী ও কর্মরত মহিলাদের জন্য যথেষ্ট আবাসন এবং নিরাপদ যানবাহনের ব্যবস্থা করিতে নানা সুপারিশ করিয়াছিল নারী ও শিশু কল্যাণ দফতর, তাহাদের নূতন নীতিতে। তাহার প্রায় কোনওটিই কার্যকর হয় নাই। কখনও বাজেট আসিলে, কখনও নির্ভয়া কাণ্ডের বর্ষপূর্তি হইলে, কখনও বা আরও একটি ভয়ানক নির্যাতনের ঘটনা ঘটিলে অসম্পূর্ণ কাজ, অনুদ্যোগী প্রশাসন লইয়া হাহুতাশ করা হয়। অতঃপর ফের বিস্মরণ। অথচ তরুণীদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি যে শুধু আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্ন নহে, তাহা যে দেশের অর্থনীতিকেও আহত করিতেছে, সে সত্যটি সম্মুখে আসিয়াছে। নগর, যানবাহন ঝুঁকিহীন, বিপন্মুক্ত নহে বলিয়াই ভারতে উচ্চশিক্ষিত মেয়েরাও কাজে যোগ দিতে অনাগ্রহী। ভারতে মাত্র সাতাশ শতাংশ মেয়ে কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়াছে, বিশ্বের নিরিখে যাহা অতি নিম্ন। মেধা ও শিক্ষার এই অপচয় অপূরণীয়। মেয়েদের নিরাপদ না করিলে ক্ষতি হইবে দেশের, বোধোদয় হইবে কবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy