না থাকিলেই ভাল হইত, এমন বহু জিনিস পৃথিবীতে রহিয়াছে। শিশুশ্রম যেমন। যাহাদের বয়স খেলিয়া বেড়াইবার, লেখাপড়া শিখিবার, তাহারা হাড়ভাঙা খাটুনি খাটিতেছে, ইহা কোনও সভ্য দেশে গ্রহণযোগ্য নহে। কিন্তু, ইহা ঘোর বাস্তব। শিশুশ্রমিক আছে। বহু ক্ষেত্রেই তাহারা বিপজ্জনক কাজে যুক্ত। পিংলার বিস্ফোরণে মৃত শিশুগুলির বিকৃত দেহ এই ভয়ঙ্কর বাস্তবের সাক্ষ্য দিবে। এক জোড়া কচি হাত সামান্য কয়টি টাকার জন্য উদয়াস্ত খাটিতেছে, দেখিলে রাজনীতিকদের বিবেক জাগিয়া উঠে। তেমনই জাগ্রত বিবেক শিশুশ্রম নিবারণ আইন প্রণয়ন করিয়াছিল। তাহাতে যে ছবিটি বদলায় নাই, তাহা অহরহ চোখে পড়ে। এ দিকে, রাজনৈতিক বিবেকের স্মৃতিশক্তি বড় ক্ষীণ। সমস্যাটি চোখের আড়াল হইলেই আবার তাহা পাশ ফিরিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। সম্প্রতি শিশুশ্রম নিবারণী আইনের নূতন যে সংশোধনী পেশ করা হইল, তাহাতে আশঙ্কা হইতেছে, অতি দ্রুত বিবেকের নাসিকাগর্জন শোনা যাইবে। শিশুশ্রমিকদের চোখের আড়াল করিবার ব্যবস্থা পাকা হইয়াছে। সংশোধনী বলিতেছে, অতঃপর শিশুরা স্কুলের নির্দিষ্ট সময়ের পর, ছুটিতে, পারিবারিক ক্ষেত্রে কাজ করিতে পারিবে। অর্থাৎ, যে পরিসরটি সচরাচর দৃশ্যগোচর হয় না, শিশুরা সেখানে খাটিবে। তাহাতে শিশুশ্রম কমিবে, ভাবিবার বিন্দুমাত্র কারণ নাই। সেই খুদে শ্রমিকদের দেখা যাইবে না, এই পর্যন্ত।
আইন বাঁধিয়া যে শিশুশ্রম নিবারণ করা যাইবে না, এত দিনে তাহা স্পষ্ট। কিন্তু, আইনের পথে অপ্রয়োজনে হাঁটিলে তাহা বিপরীত ফলদায়ী হইতে পারে। শিশুশ্রমের ক্ষেত্রেই যেমন হইতেছে। পারিবারিক ক্ষেত্রের পরিসরটিকে আইনি সিদ্ধতা দিলে বরং শিশুশ্রমিকদের অনেক বিপজ্জনক কাজের দিকে ঠেলিয়া দেওয়া হয়। বিড়ি বাঁধা হইতে বোমা নির্মাণ, বহু কাজই পারিবারিক ক্ষেত্রে ঢুকিয়া পড়ে। শিশুশ্রম যদি থাকেই, তবে তাহা সংগঠিত ক্ষেত্রে থাকিলে শিশুদের অধিকার রক্ষা পাইতে পারে। তাহারা শ্রমিকের মর্যাদা পাইতে পারে। শিশুকে শ্রমিক হিসাবে দেখা রাষ্ট্রের পক্ষে গৌরবের নহে। কিন্তু, বাস্তবটিকে যখন অস্বীকার করা যাইতেছে না, তখন আইনি প্যাঁচপয়জারে শিশুদের আরও অসহায় না করিয়া তোলাই বিধেয়। শিশুরা যদি কাজ করিতে বাধ্যই হয়, তবে তাহাদের আইনি রক্ষাকবচগুলি থাকুক। শিশুশ্রমিক নিয়োগ করিতে হইলে কী কী ব্যবস্থা করিতেই হইবে, তাহা বাঁধিয়া দেওয়া হউক। শিশুশ্রম নিবারণ করিতে আইন বাঁধিয়া দিয়াছি, অতএব আর সমস্যাটি নাই— এমন অস্বীকারের মানসিকতা হইতে সরিয়া আসিয়া সমস্যাটির বাস্তবগ্রাহ্য সমাধানের সন্ধানই কর্তব্য।
কিন্তু, তাহা স্বল্পমেয়াদি সমাধান। দীর্ঘমেয়াদে যাহাতে দেশে একটিও শিশুকে শ্রমিক না হইতে হয়, তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে। কাজটি আইনের পথে হইবে না। হইবে অর্থনীতির মাধ্যমে। শিশুশ্রমের একমাত্র কারণ দারিদ্র। সেই দারিদ্র দূর করিতে হইবে। কাজটি ঝোলাওয়ালা নীতির দ্বারা হইবে না। দারিদ্র দূর করিবার উপায়, দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়ানো। দেশের অর্থনীতি স্বাস্থ্যবান হইলে তাহার সুপ্রভাব সকলের থালাতেই প়ড়িবে। অবশ্যই সর্বজনীন বৃদ্ধির প্রয়োজন আছে। দেশের আর্থিক সমৃদ্ধি যাহাতে সুবণ্টিত হয়, তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে। কিন্তু, তাহার পূর্বে সমৃদ্ধিটি অর্জন করিতে হইবে। আইনের পিছনে কালক্ষেপ না করিয়া কর্তারা অর্থনীতিতে মন দিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy