Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

পথের দাবি

সত্য সততই সরল। তাহা এই যে, রাস্তা ও ফুটপাথ চলাচলের জন্য, হরেক কিসিমের পসরা সাজাইয়া বসিবার জন্য নহে। রাজ্য সরকার হকার নীতির নবতম যে সংস্করণটির মুসাবিদা করিতেছে, তাহার কেন্দ্রে এই কথাটি রাখিলেই আর গোল থাকে না।

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

সত্য সততই সরল। তাহা এই যে, রাস্তা ও ফুটপাথ চলাচলের জন্য, হরেক কিসিমের পসরা সাজাইয়া বসিবার জন্য নহে। রাজ্য সরকার হকার নীতির নবতম যে সংস্করণটির মুসাবিদা করিতেছে, তাহার কেন্দ্রে এই কথাটি রাখিলেই আর গোল থাকে না। কিন্তু সরলতা রাজনীতির স্বভাব নহে। ঘোলা জলে মাছ ধরিবার খেলাটিই তাহার পছন্দ। অতএব, ফুটপাথের কত অংশ হকারকে ছাড়া হইবে, তাহার হিসাব কষা চলিতেছে। ইহা রাজনীতির পাটিগণিত। সভ্য সমাজে এই অঙ্ক চলিতে পারে না। রাস্তা ও ফুটপাথের উদ্দেশ্য যানবাহন চলাচল। গাড়ির চালক এবং পথচারী, উভয়ের নিরাপত্তা এবং স্বাচ্ছন্দ্যই সেখানে একমাত্র বিবেচ্য। নৈতিক দৃষ্টিতে অপর কোনও দাবি সেখানে প্রাধান্য পাইতে পারে না।

বাস্তবের নিরিখেও পথচারী অগ্রগণ্য। যে কোনও আধুনিক শহরে রাস্তার জন্য বরাদ্দ এলাকা হওয়া প্রয়োজন অন্তত তিরিশ শতাংশ। ভারতের শহরগুলিতে তাহা গড়ে আঠারো শতাংশ। কলিকাতায় মাত্র ছয় শতাংশ রাস্তা। তাহা নিরাপদ যাতায়াতের দাবি মিটাইতেই অক্ষম। তাহার একটি ফল, পথদুর্ঘটনায় মৃত্যু। দৈনিক গড়ে চারশো মৃত্যু ভারতকে গোটা দুনিয়ায় পথমৃত্যুর রাজধানীর শিরোপা দিয়াছে। অতএব রাস্তাকে যান ও মানুষের উপযোগী করাই প্রধান লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন। ইহার উপর অপর কোনও দাবি চাপাইবার চিন্তা একান্ত অসঙ্গত। আক্ষেপের বিষয়, রাজনীতি সকল পক্ষের স্বার্থের মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন করিতে গিয়া তেমন অসঙ্গত সিদ্ধান্তই লইয়া বসে। তাই ফেরিওয়ালা বা হকারদের ‘অধিকার’ নির্দিষ্ট করিয়া সংসদ একটি আইন পাশ করিয়াছে ২০১৪ সালে। তাহাতে হকারদের বৈধতার শংসাপত্র দিয়া তাহাদের নিয়ন্ত্রণ করিবার দায় চাপানো হইয়াছে পুরসভাগুলির উপর। যাহা কার্যত চোরকে চুরি করিবার, এবং গৃহস্থকে ঘর সামলাইবার উপদেশের শামিল। প্রায় সকল শহরেই স্থান অকুলান, শূন্য জমি কিছু নাই। হকারদের জন্য স্থান নির্দিষ্ট করিবার নির্দেশের অর্থ, রাস্তা বা ফুটপাথের কিছু অংশের অধিকার হারাইবে পথচারী। হকার ব্যবসায়ের অবাধ অনুমতি পাইবে, পুরসভা কর পাইবে। গতি হারাইবে গাড়ি, প্রাণ হারাইবে পথচারী। ইহাই ন্যায্য বিধান বটে।

কলিকাতায় ঠিক তেমনই ঘটিবার উপক্রম হইতেছে। সংবাদে প্রকাশ, নূতন খসড়া হকার নীতিতে বলা হইয়াছে, ফুটপাথের দুই-তৃতীয়াংশ ছাড়িয়া হকারদের বসিতে বলা হইতে পারে। ইহা শুনিলেও হৃৎকম্প হয়। কলিকাতার ফুটপাতগুলি আদৌ প্রশস্ত নহে। তাহার এক-তৃতীয়াংশ যদি বিক্রেতা দখল করেন, তবে আরও এক-তৃতীয়াংশ অবশ্যই দখল করিবেন ক্রেতার দল। পথচারীর বরাদ্দ এক-তৃতীয়াংশ থাকিলে বর্তমান অবস্থার চাইতে পরিস্থিতি ভাল না হইয়া মন্দ হইবে, এমন সম্ভাবনাই অধিক। উপরন্তু এই নীতি হকারদের যে বৈধতা দেবে, তাহাতে ফুটপাথ হকারমুক্ত করিবার কোনও সুযোগই থাকিবে না। রাজ্যের বহু প্রাচীন পুর এলাকায় কার্যত ফুটপাথই নাই। রাস্তারই অংশ দখল করিয়া বাজার বসিয়াছে। সেখানে কি হকারদের রাস্তা দখল বৈধ করা হইবে? এই পরিকল্পনা সর্বনাশা। কলকাতা পুরসভা নির্বাচনের পূর্বে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিন লক্ষ হকারকে ট্রেড লাইসেন্স দিবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিয়াছিলেন। আদালতের আদেশে তাহা স্থগিত হয়। কিন্তু রাজনীতির তাগিদ অনস্বীকার্য, ফলে ফের এক অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের সম্মুখে রাজ্য। যদি হকারদের পুনর্বাসন করিতেই হয়, তবে শহরের রাস্তা ও ফুটপাথ মুক্ত রাখিয়া তাহা করিতে হইবে। বর্তমান বাজারগুলিতে, অথবা নূতন বাজারে স্থান দিতে হইবে। জীবিকার দাবি কখনও জীবনের অগ্রে স্থান পাইতে পারে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE