অশনি সংকেত। বর্ধমান-কাণ্ডে ধৃত খালিদ মহম্মদ। ২০ নভেম্বর, কলকাতা। ছবি: এএফপি
সপ্তাহে অন্তত এক দিন দেশের সর্বোচ্চ স্তরের গোয়েন্দা অফিসার ও নিরাপত্তা আধিকারিকরা রাজধানী দিল্লির মুক্তি এজেন্সি সেন্টারে মিলিত হন। ‘ম্যাক’ নামে বেশি পরিচিত ওই জায়গাটিতে বসে তাঁরা জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে সমকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন। আগে সচরাচর এই আলোচনা জুড়ে থাকত কাশ্মীর, পাকিস্তান, উত্তর-পূর্বাঞ্চল বা মাওবাদীদের কর্মকাণ্ড। গত কয়েক মাসে কিন্তু সবচেয়ে গুরুতর বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গ। সাধারণ ভাবে বলা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ বিপন্ন, বিপদটা স্পষ্ট এবং বাস্তব। আগের বামফ্রন্ট জমানা পশ্চিমবঙ্গকে মোটামুটি অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছিল, তৃণমূল শাসন এই রাজ্যকে জাতীয় দৃষ্টিতে ‘গুরুত্ব’ দিয়েছে একটা বিপর্যয়ের কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে বলে।
পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপারে অন্তত পাঁচটি আশঙ্কায় দিল্লি আশঙ্কিত। প্রথম এবং প্রধান উদ্বেগ হল, বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের কয়েকটি অঞ্চলে সক্রিয় অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এবং বিপজ্জনক কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বের যোগসাজশের অভিযোগ উঠেছে। ২ অক্টোবর বর্ধমানের বিস্ফোরণের সূত্রে রাজ্যে কর্মরত জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ-এর (জেএমবি) একাধিক কেন্দ্রের খবর ফাঁস হয়ে গেছে, যা থেকে একটি বিস্তৃত জঙ্গি নেটওয়ার্কের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। জেএমবি একটি ওয়াহাবি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, এখন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। তারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ এবং তাঁর আওয়ামি লিগের ভয়ঙ্কর বিরোধী। আন্তর্জাতিক জিহাদি গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয়প্রাপ্ত ও সক্রিয় জেএমবি জঙ্গিদের একটা লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে আওয়ামি লিগের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানো এবং শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। বাংলাদেশের নিরাপত্তা আধিকারিকরা মনে করছেন, তৃণমূল কংগ্রেস জেএমবি এবং জামাতে ইসলামের মতো মারাত্মক গোষ্ঠীগুলিকে সাহায্য করছে, তাঁরা এতে ভয়ানক ক্ষুব্ধ।
এই যোগসাজশের চেয়েও বেশি উদ্বেগজনক হল, পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই ইসলামি সন্ত্রাস দমনে অভিযান চালাতে অনিচ্ছুক। দিল্লির নিরাপত্তা আধিকারিকরা এটা দেখে আতঙ্কিত যে, রাজ্য পুলিশ বর্ধমান বিস্ফোরণ কাণ্ডের সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট করতে তৎপর হয়েছিল। আবার, তৃণমূল যে এখন এই ব্যাপারটি নিয়ে রাজনীতি করতে নেমেছে, এতেও তাঁরা বিস্মিত। বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনাটি স্পষ্টতই জাতীয় স্তরে গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা, অথচ এই ঘটনার তদন্তে সহযোগিতা না করে তৃণমূল কংগ্রেস এখন দাবি তুলেছেএই বিস্ফোরণ আসলে ভারতীয় জনতা পার্টি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের চক্রান্ত।
উদ্বেগের দ্বিতীয় কারণ, জাতীয় নিরাপত্তার একটি বিষয়কে তৃণমূল কংগ্রেস একটি সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে রূপান্তরিত করতে তৎপর। এ এক সাংঘাতিক চেষ্টা। দিল্লিতে এ কথা সুপরিচিত যে, পশ্চিমবঙ্গের বড় আকারের মুসলমান জনগোষ্ঠীর ভোট পাওয়ার জন্য তৃণমূল নেতৃত্ব বিভিন্ন ইসলামি সংগঠনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছেন, যাদের একটি অংশ ঠিকঠাক হলেও কিছু কিছু খুবই গোলমেলে। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ গড়ে তুলতে এই সংগঠনগুলিকে কাজে লাগানোর সুযোগ আছে, এ কথা অস্বীকার করা যায় না।
সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে একের পর এক তৃণমূল সাংসদ গ্রেফতার হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় দলের সর্বাধিনায়িকার মুখে প্রত্যাশিত হুমকি শোনা গেছে। গুরুতর অপরাধের তদন্তের প্রশ্নে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণের বদলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ তুলেছেন যে, তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ (অর্থাৎ আসলে মুসলিমদের অনুকূল) আচরণের জন্যই তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের এই ভাবে ধরা হচ্ছে। এর জন্য বিজেপি’র মুসলিম-বিরোধী নীতিকে দায়ী করে তিনি হুমকি দিয়েছেন, এই ধরপাকড়ের পালা যদি আরও চলে তা হলে তিনিও প্রত্যাঘাত করবেন। এই ভাবে আগুন নিয়ে খেলার ফলে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টি হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
এখানেই দিল্লির তৃতীয় উদ্বেগ। দুর্ভাগ্যজনক সত্য এই যে, পশ্চিমবঙ্গের পুলিশের উপর কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এবং পুলিশ সংগঠনগুলির আজ আর বিশেষ আস্থা নেই। দিল্লির ধারণা, রাজ্য পুলিশ, বিশেষত তার নীচের তলার কর্মীরা এত বেশি আপস করতে বাধ্য হয়েছেন যে তাঁদের মেরুদণ্ড বলে আর কিছু নেই। পুলিশের কিছু কিছু অংশ এখন তৃণমূল কংগ্রেসের নীচের তলার তোলাবাজদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছে, ছোট শিল্প, স্থানীয় ব্যবসা এবং খুচরো লেনদেনের উপর যাদের প্রবল আধিপত্য। ফলে নিরপেক্ষতা ও তৎপরতার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সামর্থ্যই পুলিশ হারিয়ে ফেলেছে। অথচ রাজ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় পুলিশবাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এর পিছনে আছে লুম্পেন রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত। সেটাই দিল্লির উদ্বেগের চার নম্বর কারণ। পশ্চিমবঙ্গের শহরে ও গ্রামে বিপুলসংখ্যক প্রান্তিক, আধা-নিরক্ষর লুম্পেন শ্রেণির মানুষের মনে জমে থাকা তীব্র অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস রাজনৈতিক সাফল্য পেয়েছে। এই লুম্পেন রাজনীতির উপর ভর করেই তৃণমূল রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে আধিপত্য কায়েম করেছে। লুম্পেন আধিপত্য থেকে সংগঠিত অপরাধের জন্ম হয়, মাফিয়ার নিয়ন্ত্রণ মাথা চাড়া দিতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত দেখা দেয় রাজনৈতিক অত্যাচার। আলিপুর থানায় জনতার আক্রমণ, এনআরএস হাসপাতালে গণপ্রহারে মানুষ খুন, বীরভূমের ধারাবাহিক হিংসা ইত্যাদি ঘটনাগুলি দেখিয়ে দেয়, পশ্চিমবঙ্গে অরাজকতা ক্রমশ বাড়ছে। দীর্ঘমেয়াদি বিচারে এর ফলে প্রশাসন এবং পুলিশবাহিনীরও ক্ষতি হয়। এই বিশৃঙ্খলা বড় শিল্পবাণিজ্যে বিনিয়োগের প্রতিকূল, মানবসম্পদ বিকাশের পথেও বড় বাধা।
এখানেই পাঁচ নম্বর সমস্যা: পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা। এটা ঠিকই যে, এই রাজ্যের উৎপাদন ও আয় সর্বভারতীয় গড়ের চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে। কিন্তু সেই বৃদ্ধি এসেছে অসংগঠিত ক্ষেত্রে থেকে, গ্রাম ও মফস্সলের ছোট শিল্প এবং ব্যবসা থেকে। সংগঠিত বাণিজ্য, বড় শিল্প এবং বিশেষত বহুজাতিক সংস্থার বিনিয়োগের যেটুকু সম্ভাবনা ছিল, তৃণমূল ঘরানার রাজনীতি তাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। যে উপদেষ্টারা দেশের বড় কোম্পানি এবং বহুজাতিক সংস্থাদের বিনিয়োগ সম্পর্কে পরামর্শ দেন, তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে লগ্নি করতে বলছেন না।
তৃণমূলের প্রবক্তারা যা-ই বলুন না কেন, শুধু কৃষি ও অসংগঠিত শিল্পবাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়ে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক রূপান্তর সম্ভব নয়, রাজ্যের ব্যাপক ও গভীর দারিদ্রের মোকাবিলাও অসম্ভব। সীমিত আয়, সীমিত ব্যয় এবং সীমিত সঞ্চয়ের যে অশুভ চক্রে পশ্চিমবঙ্গ বন্দি, তা থেকে মুক্তি চাইলে বড় বিনিয়োগ অত্যাবশ্যক, কোনও বিকল্প নেই। দেশের ‘পুবে তাকাও’ নীতির প্রেক্ষিতে কলকাতার একটা বিরাট সম্ভাবনা আছে, সে এই নীতি রূপায়ণের পথে কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে, অথচ দেখা যাচ্ছে সে যেন পৃথিবী থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।
দূর থেকে পশ্চিমবঙ্গকে দেখে মনে হয়, সে এক বিপন্ন, বেসামাল এবং অসুস্থ রাজ্য। কোনও রাজ্য একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে থাকতে পারে না। একটা রাজ্যের সংহতি বিপন্ন হলে সেটা গোটা দেশের পক্ষেই বিপজ্জনক। পশ্চিমবঙ্গে ঘণ্টা বাজছে। কার জন্য বাজছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেটা জিজ্ঞাসা করা উচিত নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy