Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

প্রকৃতির চেয়ে বড় বিপদ মানুষ নিজে

বিপর্যয়প্রবণ বলে কাঠমান্ডুতে গৃহনির্মাণ কড়া নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা ছিল। সে কথা মানা হয়নি। আর ভারতে? ভূবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা দূরস্থান, ভূমিকম্প প্রতিরোধ নিয়ে সচেতনতাও তৈরি হয়নি। আজ দ্বিতীয় পর্বভূমিকম্পের পূর্বাভাস নিয়ে ভূতাত্ত্বিকরা বহু বছর ধরে সক্রিয় গবেষণা করেছেন। ঠিক কোথায় ও কখন ভূমিকম্প হবে তার আগাম খবর দেওয়া অসম্ভব। আগেই বলেছি (‘অনুমান দিয়ে বিষয়টি বোঝা অসম্ভব, ৫-৫), ঘর্ষণ বা স্ট্রেস-এর ফলে ভূকম্প থেকে উৎপন্ন শক্তি নির্গত হয় মুহূর্তের মধ্যে। সমস্যা হল, স্ট্রেসের ফলে শিলাস্তরের প্রতিক্রিয়া লিনিয়ার বা রৈখিক নয়।

সম্পর্ক। যত্ন ও মনোযোগ ছাড়া যা অসম্ভব। আর্থ ডে উদ্যাপন, কলকাতা, ২২ এপ্রিল। ছবি: এএফপি।

সম্পর্ক। যত্ন ও মনোযোগ ছাড়া যা অসম্ভব। আর্থ ডে উদ্যাপন, কলকাতা, ২২ এপ্রিল। ছবি: এএফপি।

সুপ্রিয় মিত্র ও অনিন্দ্য সরকার
শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৫ ০০:০৪
Share: Save:

ভূমিকম্পের পূর্বাভাস নিয়ে ভূতাত্ত্বিকরা বহু বছর ধরে সক্রিয় গবেষণা করেছেন। ঠিক কোথায় ও কখন ভূমিকম্প হবে তার আগাম খবর দেওয়া অসম্ভব। আগেই বলেছি (‘অনুমান দিয়ে বিষয়টি বোঝা অসম্ভব, ৫-৫), ঘর্ষণ বা স্ট্রেস-এর ফলে ভূকম্প থেকে উৎপন্ন শক্তি নির্গত হয় মুহূর্তের মধ্যে। সমস্যা হল, স্ট্রেসের ফলে শিলাস্তরের প্রতিক্রিয়া লিনিয়ার বা রৈখিক নয়। যদিও অধিকাংশ বড় ভুমিকম্পের পরেই ঘটে বহুসংখ্যক ‘আফটারশক’, যেমন ঘটেছে এ বার নেপালেও, কিছু ক্ষেত্রে আবার প্রধান ভূকম্পের আগেও অনেক ছোট ছোট কম্পন অনুভূত হয়। পৃথিবীর গভীরে পাথরের ধর্ম বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম, সেটা ভূমিকম্পের পূর্বাভাসকে আরও জটিল করে তোলে। তবে যথেষ্ট ভূতাত্ত্বিক তথ্য থাকলে বৈজ্ঞানিকরা কোনও বিশেষ স্থান ভূমিকম্পপ্রবণ কি না, বা কতটা ঝুঁকি আছে, সেই সম্ভাবনা অনুমান করতে পারেন। এর জন্যে দরকার আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ক দ্বারা সংগৃহীত প্রচুর তথ্য, নিয়মিত ভূতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ, পলি থেকে পুরনো ভূকম্পনের ইতিহাস তৈরি করা। প্রয়োজন যথেষ্ট সংখ্যায় উন্নত গবেষণাগার, যেখানে শুধু ভূকম্পন বিশারদরাই থাকবেন না, থাকবে পলি ও পাথরের বয়স নির্ধারণ করার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি।

বিগত কয়েক দশকে ভূবিজ্ঞানীরা ব্যবহার করছেন গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিপিএস প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তিতে এখন পৃথিবীর উপরিস্তরের প্লেটের কয়েক মিলিমিটার সঞ্চরণ মাপাও সম্ভব। এই প্রযুক্তিতেই আমেরিকার পারডিউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এরিক কালাইস হেইতি দ্বীপে ২০১০ সালে যে এক ভয়ঙ্কর ৭.২ মাত্রার ভূমিকম্প হবে তার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। সেই ভূমিকম্প ঘটেছিল জানুয়ারির ১০ তারিখে। ঠিক কোন দিনে হবে যদিও বলা সম্ভব হয়নি, তবে সম্ভাব্য সময়ের পূর্বাভাস বাঁচিয়ে দিতে পেরেছিল বহু জীবন ও সম্পত্তি। একই ভাবে কিছুটা হলেও উপকারী হয়েছিল কোস্টা রিকার নিকোয়াতে ১৯৯১ ও ২০০১ সালে দেওয়া পূর্বাভাস— ভূকম্পন এসেছিল ২০১২ সালে। কলম্বিয়া ও বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে গত দশ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা বেঙ্গল বেসিনের বিভিন্ন স্থানে জিপিএসের সাহায্যে পলির অবনমন মাপার চেষ্টা করছেন। ২০১৪ সালে তাঁরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের উত্তরে সিলেট বেসিনে, যা হিমালয় ফোরডিপ-এর একদম কাছে, এই অবনমনের হার খুবই বেশি, যদিও ভূকম্পনের সঙ্গে এর সম্পর্ক এখনও পরিষ্কার নয়। ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতর, ন্যাশনাল জিয়োফিিজকাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট ইত্যাদি এবং বিদেশি কিছু বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি হিমালয়ের বিভিন্ন স্থানে জিপিএস স্টেশন স্থাপন করেছে, যদিও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল। কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত ভূপদার্থবিদ রজার বিলহাম ২০০৫ সালে জিপিএস তথ্য বিশ্লেষণ করে সমস্ত হিমালয় ধরেই কয়েকটি সাইসমিক গ্যাপ বা ভূকম্প-বিহীন অঞ্চলের অস্তিত্ব দেখান, যেখানে সঞ্চিত শক্তি যে কোনও সময় ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের জন্ম দিতে পারে। নেপাল ভূমিকম্পের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে এ বারের ভূকম্পন ১৮৩৩ সালের ভূকম্পনের খুব কাছেই এবং এ বারের সৃষ্ট চ্যুতিটি শেষ হয় ১৯৩৪ সালের ভূমিকম্পে সৃষ্ট চ্যুতির ঠিক উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে। হয়তো এক উচ্চমাত্রার ভূকম্পনের প্রভাবে পাশের পুরনো চ্যুতিগুলিতে সঞ্চিত শক্তি ভবিষ্যতে আরও একটা ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের জন্মদাত্রী হয়ে উঠতে পারে।

বেশ কিছু বছর যাবৎ আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতর এবং সম্প্রতি ভূবিজ্ঞান মন্ত্রক ভারতের বিভিন্ন এলাকার সম্ভাব্য ভূমিকম্প-বিপর্যয় মানচিত্র বা সাইসমিক মাইক্রোজোনেশন ম্যাপ তৈরির কাজে হাত লাগিয়েছেন। এই মানচিত্র অনুযায়ী হিমালয়ের অধিকাংশ জায়গা অতি-ভূকম্পপ্রবণ বা জোন ৪/৫ এর অন্তর্ভুক্ত। কলকাতার অন্তর্ভুক্তি হয়েছে মাঝামাঝি জোন ৩ থেকে ৪ এর ভিতর। কোনও এলাকায় যথাযথ ভূমিকম্প-বিপর্যয় মানচিত্র তৈরি করতে দরকার সেখানকার সক্রিয় চ্যুতিগুলির মানচিত্রকরণ ও তাদের সম্ভাব্য স্খলন, শিলাস্তর বা পলির মধ্যে ভূ-তরঙ্গের ত্রিমাত্রিক পরিবর্তন, পলি ও তার নীচের শিলার প্রকৃতি, পলির গভীরতার মানচিত্র ইত্যাদি ব্যাপারে বিস্তারিত ধারণা। আর তাই দরকার ভূপদার্থবিদ, ভূ-রসায়নবিদ, চ্যুতি ও পলি বিশেষজ্ঞের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও বহুধা বিষয়ের গবেষণা যা আমাদের দেশে নেই বললেই চলে।

গত ২২ এপ্রিল নিঃশব্দে পার হয়ে গেল আন্তর্জাতিক ভূ-দিবস (আর্থ ডে)। ভ্যালেন্টাইন থেকে বন্যপ্রাণী দিবস সবই ধুমধাম করে পালন করি আমরা। এই পৃথিবীর কথা শুধু আমাদের মনে হয়, যখন সুনামি বা নেপালের ভূমিকম্পের মতো কোনও বিপর্যয় আসে। সমস্ত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে ভূমিকম্পের বিধ্বংসী ক্ষমতা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি, যা ঘটেও সবচেয়ে দ্রুতগতিতে, বাঁচার কোনও সুযোগ না দিয়েই। যেমন, ভূকম্পন সতর্কীকরণের প্রায় ১০০০টি জিপিএস সেন্সরের জন্যে জাপান সরকার ২০১১ সাল অবধি খরচ করেছিল এক বিলিয়ন ডলার, এ দিকে ২০১১ সালে জাপানের সেনডাই শহরের ভূমিকম্পে মৃত বা নিখোঁজের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০,০০০-এর বেশি, ক্ষতির পরিমাণ হয় আনুমানিক ২৩৫ বিলিয়ন ডলার। চিনেও রয়েছে অজস্র ভূবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র। ২০১১ সালে চিনের বিজ্ঞান মন্ত্রক গবেষণা খাতে ৫০% অনুদান বাড়ায়। ভূবিজ্ঞান, ন্যানো-টেকনোলজি, প্রোটিন গবেষণা সহ মোট ছটি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৪৪ মিলিয়ন ডলার। খাস বেজিং-এই রয়েছে ভূবিজ্ঞানের এক বিশাল স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়: চায়না ইউনিভার্সিটি অফ জিয়োসায়েন্স। ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল অবধি চিনের একশোরও বেশি সংস্থার কয়েকশো ভূবিজ্ঞানী ‘সাইনোপ্রোব’ নামে ৩০০০ কিলোমিটার ধরে এক সুবিশাল ভূপদার্থ-ভূকম্পন বিষয়ক গবেষণা প্রকল্প চালান। ভারত নাকি এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। কোনও দিনই কি আমরা দেশের স্বার্থে এমন ভাবে হাতে হাত মেলাতে পারব? ভাবতে দুঃখ হয়, আজ ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভূপদার্থবিদ্যা পড়ানোর শিক্ষক পাওয়াই দু্ষ্কর হয়ে উঠেছে। সমস্যা হল, বিজ্ঞান গবেষণার ফল সাধারণত চট করে পাওয়া যায় না। ১৯৭৫ সালে যখন ভারতের প্রথম উপগ্রহ পাঠানো হয় তখন কি কেউ ভেবেছিল যে এই উপগ্রহ-বিজ্ঞানই এক দিন ওড়িশার উপকূলে ভয়ঙ্কর সাইক্লোন হুদহুদ-এর হাত থেকে বাঁচাবে হাজার হাজার মানুষকে?

গবেষণা দূরের কথা, ভূমিকম্প প্রতিরোধী বাসস্থান বানানো যে একটি জরুরি কাজ, সেটাই বোঝানো যায়নি মানুষকে। বাড়ি কেনার সময় আমাদের ক’জনই বা প্রোমোটারের সঙ্গে এ ব্যাপারে দর কষাকষি করি? অথচ প্রাথমিক হিসেব অনুযায়ী মূল খরচের দশ থেকে কুড়ি শতাংশ বেশি ব্যয় করলেই এ ধরনের বাড়ি বানানো সম্ভব। নেপালের ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাঠমান্ডু। ২০১০ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তর্জাতিক বিপর্যয় মোকাবিলা সংস্থার (ইউএনআইএসডিআর) রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছিল যে বিপর্যয়প্রবণ এলাকা ও পুরনো কাঠমান্ডু শহরে নতুন ভবন বা বহুতল নির্মাণ কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। সেই সুপারিশ কতটা মানা হয়েছে, তা বুঝতে আমাদের বেশি দিন অপেক্ষা করতে হল না। প্রকৃতির দিকে নজর না দিয়ে যথেচ্ছ ভাবে বহুতল বানানোর লোভ আমাদের ঠেলে দিয়েছে আজকের এই পরিণতির দিকে। একই অবস্থা দার্জিলিং-এরও। দার্জিলিংকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পর্যটনকেন্দ্র বানানোর সাধ আমাদের যতই থাকুক না কেন, ভবিষ্যতে দার্জিলিং যেন মৃত্যুশহর না হয়ে যায়। প্রোমোটার আর স্থানীয় স্বার্থের মেলবন্ধনে তৈরি হচ্ছে বধ্যভূমি। এই লেখা শেষ করার সময়ে টিভিতে হেডলাইন: ‘কাঠমান্ডু ছেড়ে দলে দলে লোক পালাচ্ছে’। ভূমিকম্প মানুষ মারে ঠিকই, কিন্তু মানুষ নিজে তার বহুগুণ বেশি সর্বনাশ ঘটিয়ে ছাড়ে।

(শেষ)

সুপ্রিয় মিত্র, আইআইএসইআর, কলকাতা-য় ভূতত্ত্ব বিভাগে শিক্ষক, ভূকম্পন মানমন্দির-এর প্রধান।

অনিন্দ্য সরকার, আইআইটি খড়্গপুর-এ ভূতত্ত্ব ও ভূপদার্থ বিভাগে শিক্ষক, ন্যাশনাল আইসোটোপ ফেসিলিটি’র প্রধান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE