Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয়১

প্রশিক্ষণের বিকল্প নাই

দিনেদুপুরে মানুষ খুন করাকে কোনও অর্থেই ‘লঘু পাপ’ বলা চলে না। কিন্তু, সেই মামলায় অভিযুক্ত ১১ জনেরই ফাঁসির আদেশ শুনিলে আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখিয়াও কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন, দণ্ডটি তুলনায় বেশিই হইয়া গেল না কি? প্রশ্নটি একাধিক কারণে উঠিতে পারে।

শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:১৪
Share: Save:

দিনেদুপুরে মানুষ খুন করাকে কোনও অর্থেই ‘লঘু পাপ’ বলা চলে না। কিন্তু, সেই মামলায় অভিযুক্ত ১১ জনেরই ফাঁসির আদেশ শুনিলে আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখিয়াও কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন, দণ্ডটি তুলনায় বেশিই হইয়া গেল না কি? প্রশ্নটি একাধিক কারণে উঠিতে পারে। প্রথমত, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে একই মামলায় এত জনের প্রাণদণ্ডের ঘটনা সম্ভবত এই প্রথম। ভাবিয়া দেখা যাইতে পারে, এত বৎসর যাহা হয় নাই, তাহা ঘটাইবার যথেষ্ট কারণ ছিল তো? ভারতীয় দণ্ডবিধির ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ‘বিরলের মধ্যেও বিরলতম’ অপরাধের ক্ষেত্রেই চরম সাজা প্রযোজ্য। জমি দখল লইয়া বিতণ্ডায় গুলি চলার ফলে এক জনের মৃত্যু, তাহা যতই দুঃখজনক হউক না কেন, ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ সম্ভবত নহে। দ্বিতীয়, এবং বৃহত্তর প্রশ্ন হইল, যে অপরাধীর আর সংশোধনের কোনও সুযোগই নাই, এবং যাহার বাঁচিয়া থাকা সমাজের পক্ষে অতি ক্ষতিকর, একমাত্র তেমন অপরাধীর ক্ষেত্রেই প্রাণদণ্ড প্রযোজ্য হওয়া বিধেয়। অপর্ণা বাগ হত্যাকাণ্ডে নদিয়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালত যে ১১ জনের ফাঁসির আদেশ দিল, তাহারা প্রত্যেকেই এই বিরল শ্রেণিতে পড়ে কি না, প্রশ্নটি থাকিতেছে। যদি তাহাদের সংশোধন-অযোগ্যতা সম্বন্ধে সংশয়ের বিন্দুমাত্রও অবকাশ থাকে, তবে সেই সংশয়টিকে আরও এক বার সুযোগ দেওয়াই বিধেয়। রত্নাকর হইতে বাল্মীকিতে উত্তরণ না হউক, অন্তত স্বাভাবিক নাগরিক হইয়া ওঠাও সমাজের পক্ষে কম ইতিবাচক উন্নতি নহে।

কেহ বলিতেই পারেন, রায়টি নিম্ন আদালতের, ফলে উচ্চতর আদালতে ভিন্নতর রায়ের সম্ভাবনা আছে। কথাটি ভুল নহে। বহু ক্ষেত্রেই দেখা গিয়াছে, নিম্ন আদালতের রায় উচ্চতর আদালতের ধোপে টেকে নাই। কিন্তু, নিম্ন আদালতও ভারতীয় বিচারব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ। সর্বোচ্চ আদালত যে সংবিধান, যে দণ্ডবিধি মান্য করিয়া চলে, নিম্ন আদালতের ক্ষেত্রেও তাহাই প্রযোজ্য। অতএব, নিম্ন আদালতের রায়ের গুরুত্বও কম নহে। কোনও ক্ষেত্রে উচ্চতর আদালত সেই রায়ের সহিত ভিন্নমত হইতেই পারে, কিন্তু সেই মতানৈক্য ব্যতিক্রম হওয়াই বিধেয়। যদি দেখা যায় ব্যতিক্রমই নিয়মে পরিণত হইতেছে, তবে বুঝিতে হইবে, কোথাও গোলমাল হইয়া যাইতেছে। উচ্চতর আদালত ও নিম্ন আদালত দার্শনিক ভাবে সম অক্ষে নাই। দেশের সমগ্র বিচারব্যবস্থা দর্শনের এক সুরে বাঁধা না থাকিলে মুশকিল। নিম্ন আদালতের রায় যদি উচ্চ আদালতে নিয়মিত খারিজ হইয়া যায়, তবে বিপুল সময় নষ্ট ভিন্ন আর কিছুই হয় না। সেই বিলাসিতার অবকাশ ভারতের নাই।

নিম্ন আদালতগুলিকে যথার্থ তারে বাঁধিবার দায়িত্ব যদি কোনও প্রতিষ্ঠান লইতে পারে, তবে তাহা সুপ্রিম কোর্ট। বিসিসিআই-এর ন্যায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ বেনিয়ম দূর করিতেও সুপ্রিম কোর্ট যতখানি তৎপর, তাহাতে কেহ অনুমান করিতেই পারেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের হাতে যথেষ্ট সময় আছে। নিম্ন আদালতের প্রশিক্ষণের কাজে সেই সময় ব্যয় করিলে বিচারব্যবস্থার উপকার। কোন প্রশ্নের উত্তর কোন পথে সন্ধান করা উচিত, কোন ভাবনা দেশের বিচারব্যবস্থার দার্শনিক অবস্থানের সহিত সঙ্গতিপূর্ণ আর কোনটি নহে, নিম্ন আদালতের জন্য তাহা স্পষ্ট ব্যাখ্যা করা বিধেয়। যে কোনও ক্ষেত্রেই পেশাদারি প্রশিক্ষণ অতি জরুরি। বিচারবিভাগও ব্যতিক্রম নহে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, শুধু যথেষ্ট আদানপ্রদান হয় নাই বলিয়াই বুঝিবার খামতি থাকিয়া গিয়াছে। নিম্ন আদালতগুলির ক্ষেত্রে এই ঘাটতি পূরণ করা অতি জরুরি। সুপ্রিম কোর্ট যদি নিম্ন আদালতগুলির জন্য ধ্রুবপদ বাঁধিয়া দিতে পারে, তাহা হইলেই ভারতের বিচারব্যবস্থা গতিশীল হইবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE