রাজ্য সরকার বিশ্বকর্মা পূজা উপলক্ষে অর্ধ-দিবস ছুটি ঘোষণা করিয়াছে। ইহা নজিরবিহীন। রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের জন্য ঢালাও ছুটির বন্দোবস্ত করার ব্যাপারে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিপূর্বেও প্রথা ভাঙিয়াছেন। তাঁহার নিশ্চয় মনে হইয়া থাকিবে যে, এই কর্মচারীরা বছরভর প্রচণ্ড কাজের চাপে ন্যূব্জপৃষ্ঠ হইয়া থাকেন, যাহাকে বলে মাথা তুলিবার সময়ও পান না। তাই ঘন-ঘন ছুটি মঞ্জুর করিয়া সম্ভবত তাঁহাদের নিরবচ্ছিন্ন কাজ করার অবসাদ ও ক্লান্তি অপনোদন করিতে এই ভাবে ছুটির হরির লুঠের বন্দোবস্ত। সরকারি কর্মচারীদের একাংশ ছুটি পাইলে আর কিছুই চাহেন না, হয়তো বকেয়া মহার্ঘ ভাতাও না। কিংবা যখন সরকারের কাছে তাঁহাদের ৪৯ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা বকেয়া পড়িয়াই আছে এবং রাজকোষের যাহা অবস্থা, তাহাতে ওই বকেয়া প্রাপ্তির সম্ভাবনাও দূরপরাহত, তখন নাকের বদলে নরুনের মতো যদি প্রাপ্য ভাতার বিনিময়ে অন্তত বাড়তি ছুটি পাওয়া যায়, তবে খানিকটা পুষাইয়া যায়। তাই বিশ্বকর্মা পূজার জন্যও ছুটির ঘোষণা।
বিশ্বকর্মা পুরাণ অনুযায়ী দেবশিল্পী, স্থাপত্যবেদের প্রকাশক, শিল্পের নির্মাতা। এ জন্যই ছোট-বড় কলকারখানায়, মেশিনপত্র রাখার স্থানে, মোটরগাড়ির গ্যারাজ ইত্যাদিতে তাঁহার পূজা হইয়া থাকে। তাঁহার মূর্তিতেও হাতে কারিগরের যন্ত্রপাতি শোভিত থাকে। শিল্প তথা কলকারখানার মরুভূমি পশ্চিমবঙ্গ হইতে বিশ্বকর্মার আশীর্বাদ কার্যত অন্তর্হিত। নিত্য একের পর এক কারখানা বন্ধ হওয়ার সংবাদ, চা-বাগান ও চটকল শিল্পে ভুখা শ্রমিকের আত্মহত্যার সমাচার। তাই কি বিশ্বকর্মাকে বরণ করার জন্য রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক সদর-দফতরের দরজা খুলিয়া দেওয়া হইল এবং বিশ্বকর্মার মূর্তির সামনে করজোড়ে দণ্ডায়মানা মুখ্যমন্ত্রীর সচিত্র প্রতিবেদন প্রচারিত হইল? সর্বদ্রষ্টা দেবশিল্পী সেই প্রতিবেদন নিশ্চয় দেখিতে পাইয়াছেন। কিন্তু শিল্প বলিতে যিনি ধূপকাঠি, জ্যাম-জেলি-আচার তৈরি ইত্যাদিকে বুঝেন, ছেনি-হাতুড়ির দেবতা তাঁহাকে কী আশীর্বাদই বা দিবেন? তবে হ্যাঁ, শিল্প বলিতে যদি কেবল বহুতল ইমারত নির্মাণকে বুঝায়, তবে বিশ্বকর্মার আশীর্বাদের প্রয়োজন অন্তত এই রাজ্যের নাই। এখানে ইট-বালি-চুন-সুরকি-লোহা-সিমেন্ট আদি ইমারতি দ্রব্যের সিন্ডিকেটগুলির রমরমা এবং শাসক দলের প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতায় তাহাদের স্ফূর্তি দেবতারও ঈর্ষা উদ্রেক করিতে পারে।
তবে বৃহত্ প্রকল্পগুলি মোটামুটি সিঙ্গুর হইতে টাটার বিদায়ের পর হইতেই পশ্চিমবঙ্গের দিক হইতে মুখ ফিরাইয়াছে। নির্মীয়মাণ প্রকল্পগুলিতেও যে ভাবে শাসক দলের স্থানীয় মাতব্বররা শিল্পপতিদের হাতে দলীয় সমর্থকদের তালিকা ধরাইয়া তাহাদের কারখানায় স্থায়ী চাকুরি দিতে চাপ দিতেছে, তাহাতে বিশ্বকর্মার পক্ষে এই রাজ্য মোটেই নিরাপদ ঠেকিতেছে না। তথাপি নবান্নে তাঁহার সাড়ম্বর ও যথাবিহিত উপাসনার আয়োজন করিয়া মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয় দেবশিল্পীর কাছে রাজ্যকে শিল্পসমৃদ্ধ করিয়া তোলার বর যাচ্ঞা করিয়াছেন। তবে তিনি আর একটা ছোট ধাপ অতিক্রম করিলেই পারিতেন। অর্ধদিবস ছুটি না দিয়া সপ্তাহের মধ্যখানে পুরা দিবস ছুটি ঘোষণা করিলেই ভাল হইত। ‘হাফ-ছুটি’ কার্যত পুরা ছুটিতেই পর্যবসিত হয়। অর্ধ দিবস খোলা রাখিতে গিয়া সরকারের বাড়তি খরচ হয়, কর্মীদেরও, তদুপরি বিশ্বকর্মার আশীর্বাদেও কিছু কম পড়িয়া যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy