Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

প্রাণেশাচার্যকে তো আগে চিনতাম না

ইউ আর অনন্তমূর্তির লেখা পড়েই বুঝতে শিখেছিলাম যে, নিজ নিজ ভাষার বাইরে আরও অন্য ভাষার সাহিত্য আছে, যেগুলির খোঁজ নেওয়া অবশ্যকর্তব্য।ইউ আর অনন্তমূর্তির লেখা পড়েই বুঝতে শিখেছিলাম যে, নিজ নিজ ভাষার বাইরে আরও অন্য ভাষার সাহিত্য আছে, যেগুলির খোঁজ নেওয়া অবশ্যকর্তব্য।

ঈপ্সিতা হালদার
শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

ইউ আর অনন্তমূর্তি মারা গেলেন। বয়স হয়েছিল বিরাশি। তিনি কন্নড় ভাষায় লিখেছেন। পেয়েছেন পদ্মভূষণ, জ্ঞানপীঠ, অকাদেমি ফেলোশিপ ও আরও নানা সম্মান। তাঁর পাঁচটি উপন্যাস, একটি নাটক, আটটি ছোটগল্পের বইয়ের অভিঘাত এমনই প্রবল যে, তিনি আন্তর্জাতিক বুকার মনোনয়নের আওতায় আসেন।

যখন তুলনামূলক সাহিত্য পড়তে আসি, আমরা কেউ অনন্তমূর্তির নাম শুনিনি তখনও। ফলত প্রাণেশাচার্যেরও না। আমরা গোরা জানতাম। গোঁড়া বিশ্বাসী গোরা জানত, ভারতবর্ষের সার হল বৈদিক ব্রাহ্মণত্বে। আর জানত, আলোকপ্রাপ্ত ব্রাহ্মিকা মানে খারাপ। যত বার সুচরিতার সঙ্গে কথা বলত, তার চিন্তাভাবনার ক্ষমতায় যতক্ষণ গোরা অবাক হয়ে যেত, সেই সুযোগে কথক দেখিয়ে দিতেন কথা বলার সময় সুচরিতার চোখ কখন নিচু হচ্ছে, সেজের আলো কেমন এসে পড়ছে সুকুমার কপোলে। প্রত্যেক বার তার পরই গোরা ভারতবর্ষকে খুঁজে পেতে বেরোত। এখন বুঝে গিয়েছি যে ওই নারীটির অমোঘ টান এড়াতেই সে পালাত। কী পেত জানা যায় না, কিন্তু গণ্ডাখানেক শান্তিস্বস্ত্যয়ন চলত অজাতে কুজাতে মেলমেশের প্রাচিত্তির হিসেবে, ফেরার পর। ততক্ষণ অবধি গোরা জাতপাত হিন্দুমুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টানের ভারতকে ভারতবর্ষের উল্টো দিকের সত্যি হিসেবে ধরতেই পারেনি, যত দিন না সে জানতে পেরেছে সে হিন্দু না, এমনকী ভারতীয়ও না, পালিত আইরিশ সন্তান। যৌনতাবোধের উন্মোচনমাত্রে গোরার এই নৈঃশব্দ্য এটাই জানায় যে, যৌনতাবোধ এমনই একটা শক্তি যা, গোরা নিজেকে যা ভেবেছিল, ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতীয়ত্বের অটল মূর্ত রূপ যেন বা, তাকে ধসিয়ে দিতে পারে।

মানববাবু, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় পড়াতে শুরু করলেন ‘সম্স্কারা’। সংস্কার। অগ্রহার, ব্রাহ্মণদের গ্রামে প্লেগ হয়েছে। মারা গিয়েছে নারানাপ্পা। কিন্তু তার সত্‌কার হবে কি না জানা নেই, কারণ সে ব্রাহ্মণ হয়েও মদ্যমাংস খেয়েছে, বিয়েটিয়ে না করেই নিচু জাতের এক অতিযৌবনা নারী চান্দ্রির সঙ্গে থেকেছে। প্রাণেশাচার্য সবচেয়ে জ্ঞানী, সবাই তার কাছে ভিড় করে উত্তর জানতে চেয়ে। এই সব ব্রাহ্মণ, তারা খুব শুদ্ধ, তাদের স্ত্রীরা শুদ্ধ আরও, কেননা তাদের শেখানো হয়েছে পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা, কাজেই তারা যৌনতাকালে কাঠের মতো পড়ে থাকে সিলিংয়ের দিকে চেয়ে। শৃঙ্গার বলে কোনও বস্তু নেই। কারও কারও নারানাপ্পার মতো সাহস নেই, তারা ঘোর রাত্তিরে লুকিয়ে চাষের খেতে অজাতের মেয়েদের সঙ্গে শুতে যায়। কিন্তু এই সব উল্লঙ্ঘনের কারণ হল, তাদের বউরা তাদের যৌনতৃপ্তি দিতে পারে না। প্রাণেশাচার্য সম্পূর্ণ আদর্শ ব্রাহ্মণ, বিশুদ্ধ, কেননা তার স্ত্রী চলচ্ছক্তিহীন। অতএব প্রাণেশাচার্য শারীরিকতা নামক পাঁকের বাইরে।

কিন্তু নারানাপ্পার দোষের উপযুক্ত বিধান কোনও ধর্মশাস্ত্র ঘুঁটে পাওয়া যায় না। সে আতান্তরে পড়ে যায় যে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া নেই, কী করি সেই প্রশ্ন লইয়া? কারণ এ জীবনে সে তা-ই করে এসেছে, তা-ই বলে এসেছে, যা আগেই বলে দেওয়া। এবং সে উপলব্ধি করে, যে প্রশ্নের উত্তর মানে-বইয়ে দেওয়া আছে, নিজে খুঁজে তৈরি করতে হয় না, সেগুলো তো প্রশ্নই নয়, তাই এই বাঁচা প্রশ্নহীন। সে-সময় আচমকা যা করার নয়, শাস্ত্রে করতে বলেনি, এমনই কিছু করে ফেলে সে। চান্দ্রির সঙ্গে প্রস্তুতিহীন শৃঙ্গার। এ ঠিক না ঠিক নয়, এই দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, কারণ যে উন্মোচন হয় প্রাণেশাচার্যের শরীরের, তা এত মনোলোভা যে, আচার্য হিসেবে তার যে স্বেচ্ছাবৃত রোলমডেল-পদ, তাতে ফিরে যাওয়া অসম্ভব হয়। যা যা শাস্ত্রে লেখেনি, এই বার প্রাণেশাচার্য তার মধ্যে যায়, কাদামাটি গায়ে লাগে যৌনতাকালে, তার গন্ধ লেগে যায়। পথে ঘুরে, মেলায় মোরগ-লড়াইয়ের আগ্রাসী খিঁচুনিতে, ক্ষুত্‌কাতর হয়ে নিচু জাতের সঙ্গে পঙ্ক্তিভোজনে এত কাল বাঁচিয়ে চলা কঠিন ব্রাহ্মণ পবিত্রতা ঘুচিয়ে হাক্লান্তিতে ব্যথায় বমিতে মাথা ভোঁ-ভোঁ’তে, প্রাণেশাচার্য নামে প্রতিষ্ঠানটিকে আর খুঁজে না পেয়ে এ বার কী করবে সে!

অনুপদা মন আর সমাজের নিবিষ্ট সন্ধানী অনুপ ধর বলেছিল, দ্যাখ, এইটা, মানে এই অপ্রস্তুত সঙ্গম অন্য ব্রাহ্মণদের নিচু জাতের মেয়েদের সঙ্গে শোয়ার থেকে আলাদা। অন্যরা শুয়েছে স্রেফ, কোনও আত্মআবিষ্কারে যায়নি, শরীরকে নেয়নি অজানা জ্ঞান বলে, যাতে ভেঙে যেতে পারে শাস্ত্রচর্চা বা মাথা দিয়ে সব কিছু জানা ও বোঝা। শরীরের কামনা আসলে একটা প্রতীক, জাতপাত দিয়ে তৈরি ব্রাহ্মণবাদী ভারতবর্ষের বদ্ধ বেদে-আছে-অতএব-সত্যি ধারণাটাকে যা ভেঙে দিতে পারে। স্থিতাবস্থা চুরমার করে দিতে পারে।

আমরা ততক্ষণে পুজোয় বা বইমেলায় রাদুগা-র কল্যাণে মাত্র কিছু রুশ ক্লাসিকের অনুবাদ জানি, দু’তিনটে আমেরিকা-ইউরোপ জানি দেব সাহিত্য কুটীরের বদান্যতায়। কিন্তু বাংলা বাদে দেশের সাহিত্যের সংস্কৃতির কোনও ধারণা নেই আমাদের। অনন্তমূর্তি আমাদের প্রথম ভারতীয় সাহিত্য। ২০০৩ সালে এক বার মহীশূরে তুলনামূলক সাহিত্যের কনফারেন্সে তাঁকে ভারতীয় সাহিত্য নিয়ে অতি মর্মস্পর্শী বিশ্লেষণ করতে শুনি। না, তার পরে আমি বা আমার বন্ধুরা কেউই তাঁর সঙ্গে এক টেবিলে কফি খাওয়ার সৌভাগ্যে পৌঁছইনি। শুধু ইংরেজি অনুবাদে একটা উপন্যাস আর বাংলায় একটা ছোটগল্প ‘ঘটশ্রাদ্ধ’ পড়ে আলোড়িত হয়ে তাঁকে নিজেদের বলে ভেবেছি। এই ভাবে তাঁকে নিজেদের বলে দাবি করায় অন্য অন্য ভাষা সাহিত্যের দিকে আগ্রহ উসকে উঠেছে। বুঝেছি গাঁইগোত্রহীন অজ পাড়াগাঁয়ের একক ব্যক্তির যৌন-অন্বেষণকে একটা দেশের সামাজিক ইতিহাসের রূপক হিসেবে যে পড়তে পারা যাচ্ছে, তা তৈরি হয়েছে কতখানি মুনশিয়ানায়। বুঝেছি সংস্কৃত নামক বিপুল যে ঐতিহ্যমন্দিরে দাঁড় করানোর জন্য এত আয়োজন, তা লোকজের অস্পৃশ্যের ঘাম রক্ত বেদনা ক্রোধ শারীরিক উল্লাসে ভেঙে পড়তে পারে। আর তার আহ্বান থাকতে পারে মার্গের মধ্যেই, যেমন প্রাণেশাচার্য, নিজে ভেঙে গেল। একটা সংস্কৃতিতে চলমান বহমান থাকতে গেলে সমাজের জন্য অর্থবহ হতে গেলে বারংবার নিজেকে ভেঙেই গড়তে হয়, আমরা তা ভেঙে পড়তেও দেখি, আর এখানেই যৌনতার বিরাট শক্তি, কারণ তার জোর সবচেয়ে অজানা। তা সর্বাপেক্ষা রহস্যঘন।

সব তো আর পড়তে পারিনি, অনুবাদ নেই বলে। কিন্তু অনেকেই তাঁর উপন্যাস থেকে তৈরি ফিল্ম সংস্কার, ঘটশ্রাদ্ধ, দিকশা দেখে জেনেছি ব্রাহ্মণ্য সমাজে জাতপাতের হিংস্রতাকে তিনি কঠোর সমালোচনা করতে চেয়েছেন। খানিকটা অ্যাকটিভিজ্মই হয়তো বা।

আমরা তো আর উনি জ্ঞানপীঠ, পদ্মভূষণ এই সব জেনে উপন্যাস পড়তে বসিনি। কিন্তু অনন্তমূর্তি পড়েই বুঝতে শিখেছিলাম যে, নিজ নিজ ভাষার বাইরে আরও অন্য ভাষার সাহিত্য আছে, যেগুলির খোঁজ নেওয়া অবশ্যকর্তব্য। না হলে হয় অন্যরা তিলিতামলিউড়েমেড়ো আর আমরা আ মরি বাংলা ভাষা ভেবে প্রাদেশিকতার তৃপ্তির ঢেকুর তুলব, বড়জোর টিভি দেখে ভারত বলতে হিন্দি হ্যায় হম শুধু মনে করতে থাকব। বরং নিজেদের ভারতীয় ভাবলে তার অর্থ তৈরির প্রয়োজন আছে অন্য প্রাদেশিক আঞ্চলিকের মাত্রায়, আঞ্চলিকের মধ্যে নানা স্তরের সন্ধানে। যদিও আজ মনে হয়, এত বড় অস্তিত্ববাদী বিপ্লব ঘটল প্রাণেশাচার্যের, আর মেয়েরা, ব্রাহ্মণী বা শূদ্রাণী, রয়ে গেল সেই বিপ্লবের সেবাদাসী হয়ে!

এ নয় যে অনন্তমূর্তির জীবন দিয়ে আমাদের এই সব বুঝতে হবে। অনন্তমূর্তি ছিলেন প্রবল কন্নড়পন্থী। আগ্রাসী জাতীয়ের উলটো দিকে ভাষার স্বাতন্ত্র্য তাঁর রাজনৈতিক প্রকল্প। কিন্তু তা করতে গিয়ে কখনও কখনও আঞ্চলিক ভাষা ও অঞ্চল যে একই জিনিস নয়, এটা অবহেলা করে ফেলেছেন। বিতর্কিত হয়েছেন এই বলে যে, ইংরেজির আধিপত্যের ফলে মধ্যমেধা গ্লোবাল সাহিত্যের আসর চষে বেড়াচ্ছে, যেখানে দেশি ভাষায় কত দাপটে লেখা হচ্ছে তার কোনও হিসেব থাকছে না। এই প্রধানমন্ত্রীর জমানা এলে দেশ ছেড়েই চলে যাবেন বলার পর ফেরত নেন তিনি, দেশ ছেড়ে যাওয়া কারও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না এই বিতর্ক ওঠায়।

এ দিকে এই কথা যেখানে লাগার সেখানেই লাগে। যে বদ্ধ, অন্ধ, প্রশ্নহীনতাকে আজীবন ভেঙে পড়তে দেখতে চাইলেন, তারাই তাঁর কুশপুত্তলিকা পোড়াল মৃত্যুর পর। তাঁর লেখা একটি বাক্যও না পড়ে। পড়লে অবশ্য অনেক আগেই পুড়ত কুশের পুতুল।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial ipsita haldar u r ananthamurthy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE