প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যাহার জন্মলগ্নেরও বহু আগে হইতে তাহাকে লইয়া বিতর্কের বন্যা বহিতেছে। এই বিতর্ক-বন্যায় নবতম সংযোজন তৃণমূল কংগ্রেস নেতা সৌগত রায়ের বক্তব্য। তাঁহার মত, প্রেসিডেন্সিকে ‘কলেজ’ হইতে এক আঁচড়ে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ না বানাইলেই ভাল হইত, তিনি কখনও এই রূপান্তর সমর্থন করেন নাই। অবশ্যই ইহা তাঁহার ব্যক্তিগত অভিমত। দল-কর্তৃপক্ষ সঙ্গে সঙ্গে তাহা স্পষ্টও করিয়া দিয়াছে। স্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় না হইয়া স্বশাসিত কলেজ হইলেই প্রেসিডেন্সির কপালে এত হেনস্থা জুটিত না, ইহাও তাঁহার ব্যক্তিগত অভিমত। ইহার সপক্ষে ব্যবহারযোগ্য তথ্য বা অনুমান, কোনও প্রমাণই পাওয়া কঠিন। সুতরাং, বিতর্কের এই সংযোজন অংশটি লইয়া বেশি কথা বাড়াইবার প্রয়োজন নাই। কিন্তু একটি কথা বলিবার প্রয়োজন আছে। কলেজ হউক বা বিশ্ববিদ্যালয়, নূতন করিয়া কোনও প্রতিষ্ঠান গড়িবার সময় কতগুলি পদ্ধতি মানিয়া চলা প্রয়োজন। অথচ সেই সব পদ্ধতিকে গুরুত্ব দেয় নাই প্রেসিডেন্সি। আজ তাহার (কু)ফল ফলিতেছে। সৎ উদ্যোগই তো যথেষ্ট নহে, তাহাকে বাস্তবায়িত করিতে সম্যক পথও জরুরি। প্রেসিডেন্সির সংস্কার সেই সম্যক পথ ধরিতে পারে নাই।
যেমন, একটি চালু প্রতিষ্ঠানকে যদি মৌলিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ভিতর হইতে ঢালিয়া সাজিতে হয়, তবে আগেকার প্রতিষ্ঠানটিকে সাময়িক ভাবে বন্ধ করিয়া সে কাজ করা বিধেয়। প্রাক্তন প্রেসিডেন্সি কলেজকেও বছর-তিনেকের জন্য বন্ধ করিয়া দেওয়া যাইত। আগের ছাত্রছাত্রীদের পার করিয়া নূতন প্রতিষ্ঠানের মতো আবার গোড়া হইতে শুরু করা যাইত। নাড়ি না কাটিলে নূতনের পূর্ণ বিকাশ হয় না, উহা পুরাতনের লেজ হইয়াই ঝুলিতে থাকে। প্রেসিডেন্সির কপালে ঠিক তাহাই ঘটিয়াছে। স্বশাসন চালু করিবার সময়, একসঙ্গে আগেকার সব কয়টি বিষয়-বিভাগ না চালাইয়া ধাপে ধাপে বিভাগগুলি বাড়ানো যাইত। তাহাতে শিক্ষামান রক্ষা করা সম্ভব হইত, উপযুক্ত শিক্ষকদের যথাযথ নিয়োগ হইত, কোনও ভুল হইয়া থাকিলে তাহার সংশোধনের সুযোগ হইত। সে সব হয় নাই বলিয়া প্রেসিডেন্সির পূর্বজীবনের ছায়া উত্তরজীবনের উপর আজও প্রবল এবং দুর্দমনীয়। সরকারি তর্জনীর দাপট বর্জন হইতে বেতনকাঠামোর বৈপ্লবিক সংশোধন হইতে শিক্ষা তথা শিক্ষকদের উচ্চ মান ধরিয়া রাখা, কোনও কাজটিই হইল না। হইবার বিশেষ আশাও নাই।
আসল কথা, যাঁহারা নূতন প্রেসিডেন্সির জন্মের সহিত যুক্ত ছিলেন, তাঁহাদের ভাবনায় এই বিষয়গুলি স্থান পায় নাই। তাঁহারা ভাবেন নাই যে, একটি নূতন প্রতিষ্ঠান তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক জ্ঞান আর সারস্বত জ্ঞান উভয়ই সমান প্রয়োজন। ভাল ইতিহাসবিদ, অর্থনীতিবিদ বা বিজ্ঞানবিদ হইলেই যে কেহ প্রতিষ্ঠান-নির্মাণে দক্ষ হইবেন, তাহা না-ই হইতে পারে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান শেষ অবধি একটি উদ্যোগ। কোনও নূতন উদ্যোগের জন্ম ও বিকাশের যে রাস্তা, তাহার সঙ্গে সারস্বত মস্তিষ্কের যোগ হইলে তবেই সাফল্যের আশা। এ দেশে অতীতে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট বা দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্স-এর মতো প্রতিষ্ঠান জন্মিয়াছে ঠিকই, সারস্বত পণ্ডিতরাই যাহাদের জন্মদাতা। কিন্তু ওই দৃষ্টান্তগুলি ব্যতিক্রমী, মূল স্রোত নয়। প্রেসিডেন্সির কপালে ব্যতিক্রম জুটিল না। প্রেসিডেন্সি আবার জন্মিয়া প্রমাণ করিল যে তাহার কোনও নবজন্ম হয় নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy