Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

ফতোয়া ও বিচার

ফতোয়া তথা শরিয়তি আদালতের রায়কে কার্যত আইনবহির্ভূত আখ্যা দিয়াছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চ রায় দিয়াছে, মুঘল কিংবা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে ফতোয়ার যে মর্যাদা বা প্রাসঙ্গিকতাই থাকুক, স্বাধীন ভারতের সাংবিধানিক বন্দোবস্তে ইহার কোনও স্থান নাই। কোনও ফতোয়া যদি ব্যক্তির সংবিধান-প্রদত্ত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে, তবে তাহা বেআইনি, এবং জবরদস্তি সেই ফতোয়া কার্যকর করার অবৈধ চেষ্টা আইনগত ভাবে মোকাবিলা করা উচিত।

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৪ ০০:০৬
Share: Save:

ফতোয়া তথা শরিয়তি আদালতের রায়কে কার্যত আইনবহির্ভূত আখ্যা দিয়াছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চ রায় দিয়াছে, মুঘল কিংবা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে ফতোয়ার যে মর্যাদা বা প্রাসঙ্গিকতাই থাকুক, স্বাধীন ভারতের সাংবিধানিক বন্দোবস্তে ইহার কোনও স্থান নাই। কোনও ফতোয়া যদি ব্যক্তির সংবিধান-প্রদত্ত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে, তবে তাহা বেআইনি, এবং জবরদস্তি সেই ফতোয়া কার্যকর করার অবৈধ চেষ্টা আইনগত ভাবে মোকাবিলা করা উচিত। বস্তুত, কেবল শরিয়তি আদালত নহে, বিচারব্যবস্থার বাহিরে যে কোনও ধরনের ‘বিচার’ সম্পর্কেই এই রায় আপাতদৃষ্টিতে প্রযোজ্য হইবে। যেমন হরিয়ানার মতো রাজ্যের খাপ পঞ্চায়েত কিংবা পশ্চিমবঙ্গের ‘সালিশি সভা’। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ আদালতের এই রায়। স্বস্তির কথা, আপাতবিতর্কিত এই রায়ের কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৎক্ষণাৎ দেশের ধর্মীয় সংগঠনগুলির তরফে ব্যক্ত হয় নাই। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড বরং রায়টিকে একপ্রকার স্বাগতই জানাইয়াছে।

ভারতের মতো একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশে শরিয়তি আদালত, কাজির বিচার কিংবা সালিশি সভার জারি করা ফতোয়া অথবা রায় কতখানি আইনসিদ্ধ, তাহা লইয়া তর্ক দীর্ঘ দিনের। বিশেষত, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান যেহেতু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিজস্ব ব্যক্তিগত আইন বহাল রাখার সংস্থান করিয়াছে, তাই শরিয়তি আইনের প্রয়োগ ও আদালতে কাজি বা মুফ্তির ফতোয়াকে দেশের দেওয়ানি বিচারব্যবস্থার সমান্তরাল একটি বন্দোবস্ত রূপে গণ্য করার প্রবণতা বিভিন্ন সময়ে নানা মহলে দেখা গিয়াছে। কিন্তু ভারতীয় সংবিধান কখনওই ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সংখ্যালঘুদের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার খর্ব বা ক্ষুণ্ণ করার অধিকার কাহাকেও দেয় নাই। অথচ ধর্মীয় বিধানের নামে কাশ্মীরের জনপ্রিয় মহিলা সঙ্গীত ব্যান্ডকে নিষিদ্ধ করা হইয়াছে, মুজফ্ফরনগরের ইমরানা নাম্নী মহিলাকে তাঁহার শ্বশুরের দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার পর নিজের স্বামীকে পুত্র জ্ঞান করার মতো বর্বরতা শিরোধার্য করিতে বাধ্য করা হইয়াছে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মুসলিম ধর্মীয় নেতা এবং পার্সোনাল ল’ বোর্ডের সদস্যরা প্রতিবাদ করিয়াছেন। কিন্তু তাহার পরেও এই সমস্যা মেটে নাই। তাহার একটি কারণ শিক্ষা বা তথ্যের অভাব। ফতোয়া যে ‘অভিমত’ মাত্র, তাহা মানিতে কাহাকেও বাধ্য করা যায় না, এই সার সত্যটি বৃহত্তর সংখ্যালঘু জনসমাজে সে ভাবে প্রচারিত হয় না।

সুপ্রিম কোর্ট দেশের আইনকেই অন্য সব ধরনের বেসরকারি বা গোষ্ঠী-সম্প্রদায়গত নিজস্ব বিচারপদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার ঊর্ধ্বে স্থাপন করিয়াছে। কারণ সংবিধান অনুসারে দেশের আইন অনুযায়ী পরিচালিত বিচারব্যবস্থারই প্রাধান্য থাকা উচিত। কোনও মুসলিম স্থানীয় ভাবে তাঁহার পারিবারিক বা ব্যক্তিগত বিরোধের নিষ্পত্তির জন্য শরিয়তি আদালতের দ্বারস্থ হইলে সেটা তাঁহার নিজস্ব ব্যাপার। কাজি বা মুফ্তির বিচারে তিনি যদি সন্তুষ্ট হন, তাঁহার প্রতিপক্ষও যদি তুষ্ট থাকেন, তবে দেশের প্রচলিত দেওয়ানি বিচারপ্রক্রিয়ার উপর চাপও কিছুটা লাঘব হয়। কিন্তু ওই ব্যক্তিগত আইনের রায় যদি সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে তুষ্ট না করে, তবে তাঁহারা দেশের দেওয়ানি বিচারব্যবস্থার দ্বারস্থ হওয়ার অধিকারী। আর সেই বিচারব্যবস্থার রায়ই সকলকে শিরোধার্যও করিতে হইবে। এক হিসাবে এ সকলই স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু দেশের আইন ও নাগরিকের অধিকার সম্পর্কে সাংবিধানিক অবস্থানটি পুনরুচ্চারণ করা জরুরি ছিল। অভিন্ন দেওয়ানি বিধির অভিমুখে যাত্রার সূচনাও এই রায়ে নিহিত থাকিতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE