Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

বঞ্চনার কার্ড

মহিলা কার্ড কি সত্যই আছে? মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্ভাব্য রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি, আছে। হিলারি ক্লিন্টন ‘মহিলা কার্ড’ দেখাইয়া সমর্থন আদায় করিতেছেন, বলিয়াছেন ট্রাম্প। তাহাতে ক্ষোভ অপেক্ষা ব্যঙ্গকৌতুকই উৎসারিত হইয়াছে বেশি। সোশ্যাল মিডিয়ায় কেহ বলিয়াছেন, নিউ ইয়র্কের পাতাল রেল হিলারিকে যে কার্ডটি দিয়াছিল, তাহা মহিলা কার্ড বলিয়াই প্রবেশ পথে বিকল হইয়াছিল।

শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

মহিলা কার্ড কি সত্যই আছে? মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্ভাব্য রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি, আছে। হিলারি ক্লিন্টন ‘মহিলা কার্ড’ দেখাইয়া সমর্থন আদায় করিতেছেন, বলিয়াছেন ট্রাম্প। তাহাতে ক্ষোভ অপেক্ষা ব্যঙ্গকৌতুকই উৎসারিত হইয়াছে বেশি। সোশ্যাল মিডিয়ায় কেহ বলিয়াছেন, নিউ ইয়র্কের পাতাল রেল হিলারিকে যে কার্ডটি দিয়াছিল, তাহা মহিলা কার্ড বলিয়াই প্রবেশ পথে বিকল হইয়াছিল। ট্রাম্পকে বিদ্ধ করিতে কেহ বা বলিয়াছেন, ঠিকই তো, সকল মার্কিন মহিলা প্রেসিডেন্টই মহিলা কার্ড ব্যবহার করিয়া জিতিয়াছেন। এমন নানা লঘু রসিকতার বান ডাকিলেও, মূল প্রশ্নটির ওজন কম নহে। অনেকেই বলিবেন, বিশ্বের সকল দেশেই কি মহিলারা জনজীবনে বাড়তি সম্মান ও সুবিধা পান না? সনিয়া গাঁধী বা হিলারি ক্লিন্টন অর্থবান, ক্ষমতাবান পরিবারের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও, মহিলা বলিয়াই কেন সহানুভূতির যোগ্য হইবেন? সাধারণ পরিবারের মহিলারাও পিছাইয়া নাই। ভারতে স্থানীয় প্রশাসনে মহিলাদের জন্য অর্ধেক আসন সংরক্ষিত। সরকারি চাকরি কিংবা উচ্চশিক্ষার বৃত্তিতে মহিলাদের জন্য যোগ্যতার শর্ত শিথিল। নির্দয় আয়কর বিভাগ অবধি তাহাদের অধিক ছাড় দেয়। ইহার পরেও ‘মহিলা কার্ড’-এর কথা বলিলে গোঁসা কীসের?

ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ, রাজনৈতিক শিষ্টাচারের খাতিরে অপরে যাহা গোপন করে, তিনি তাহা খোলাখুলি বলিয়া দেন। মহিলা কার্ড প্রসঙ্গটিও ব্যতিক্রম নহে। বহু পুরুষই মনে করেন, কেবল নারী-পরিচিতির জোরে রাজনৈতিক মঞ্চে, কর্মজীবনে, থানায়-আদালতে মহিলারা বহু সুবিধা পান। পুরুষ সদা-অপরাধী আর মহিলারা সদা-আক্রান্ত— এই ছাঁচে আইন, প্রশাসন, বিচার, সকল বিভাগই চলিতেছে। ট্রাম্প বলিবেন, সে কথা প্রকাশ্যে বলিয়া তিনি কী অপরাধ করিয়াছেন? কেবল মার্কিন মুলুকেই নহে, মহিলা কার্ড প্রসঙ্গে এ দেশেও ট্রাম্পের বেশ কিছু সমর্থক মিলিবে।

এবং তাহাতে ফের ট্রাম্প ও তাঁহার অনুগামীদের মাত্রাজ্ঞানের অভাব স্পষ্ট হইবে। বহু প্রজন্ম ধরিয়া মহিলাদের প্রতি যে বিপুল বৈষম্য হইয়াছে, গত কয়েক দশকের কিছু বাড়তি সুবিধা তাহার অতি সামান্য ক্ষতিপূরণ। ভারী ভারী বাটখারার বিপরীতে কয়েকটি নুড়ি চাপাইলে যা হয়, সরকারি অনুগ্রহে পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র-সমাজে মেয়েদের সেইটুকুই ‘উপকার’ হইয়াছে। রাজনীতি, কর্মজগৎ, সমাজ ও পরিবারের যে দিকেই দৃষ্টি পড়িবে, সেখানেই বৈষম্যের চিত্র। কলিকাতার গৃহ-পরিচারিকাদের উপর একটি সাম্প্রতিক গ্রন্থে শমিতা সেন ও নীলাঞ্জনা সেনগুপ্ত নানা গবেষককে উল্লেখ করিয়া দেখাইয়াছেন, শিল্পায়ন সর্বত্র মেয়েদের অধিক নিয়োগের সুযোগ দেয় নাই। ভারতে অর্থনীতির বিশ্বায়ন মেয়েদের আরও কোণঠাসা করিয়াছে। সংগঠিত ক্ষেত্রে তাঁহাদের উপস্থিতি কমিয়াছে। গৃহ-পরিচারিকা ও রাস্তার বাজারের বিক্রেতা, অসংগঠিত ক্ষেত্রের এই দুটি কাজে তাঁহাদের সংখ্যা বাড়িয়াছে। আশির দশকে গ্রামীণ অ-কৃষি ক্ষেত্রে এবং শিল্প-কারখানায় মেয়েদের নিয়োগ কিছু বাড়িয়াছিল। সেই লাভটুকু পরবর্তী দুই দশকে মেয়েরা হারাইয়াছে। অতি-অল্প রোজগারে কোনও মতে বাঁচিবার কাজগুলি সর্বত্র মেয়েদের জন্য রাখিয়াছে বাজার ও রাষ্ট্র। আসন সংরক্ষণ করিয়া মহিলা জনপ্রতিনিধি বাড়াইলেও এই মৌলিক নকশায় পরিবর্তন দুঃসাধ্য। ‘মহিলা কার্ড’ যদি কিছু থাকে, তবে তাহা বঞ্চনার পাসবই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE