সব বর্ষপূর্তি সমান নহে। জুন মাসের ২৯ তারিখ একটি ঐতিহাসিক ঘোষণার এক বৎসর পূর্তি হইল। গত বৎসর ওই দিনে ইসলামিক স্টেট নামক জঙ্গি বাহিনী ইসলামি খলিফার শাসন প্রতিষ্ঠার শপথ লয়। তাহাদের শীর্ষ নেতা আবু-বকর আল বাগদাদিকে খলিফা বলিয়া স্বীকৃতিও দেয়। তাহার পর গোটা বৎসর ধরিয়া আই এস-এর জয়যাত্রার গতি বাড়িয়াছে, সিরিয়া, ইরাক ও তৎসন্নিহিত একের পর এক অঞ্চল তাহাদের আয়ত্তাধীন হইয়াছে, বহু সহস্র মানুষ নিধনের দৃষ্টান্ত তাহারা স্থাপন করিয়াছে। বিরুদ্ধ শক্তিও অবশ্য অনেক সংহত রূপ ধারণ করিয়াছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে পশ্চিমী সেনাবাহিনী আই এস অধিকৃত স্থানগুলির উপর বিমানহানা, বোমাবর্ষণ ঘটাইয়াছে। আই এস-এর দৌলতেই পশ্চিম এশিয়ার সংঘর্ষক্ষেত্রটি ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত প্রসারিত হইয়াছে। খলিফা-শাসন ঘোষণার এক বৎসর পার হইবার মুহূর্তে এ বিষয়েও সন্দেহের অবকাশ নাই যে, পশ্চিমী প্রতি-আক্রমণ সত্ত্বেও আই এস-এর প্রতাপে এতটুকু টোল পড়ে নাই, তাহার ভবিষ্যৎ যথেষ্ট উজ্জ্বল! যে পরিমাণ অস্ত্র, সামরিক বাহিনী, জনসমর্থন ইতিমধ্যেই তাহাদের করায়ত্ত, তাহাতে ইহার আন্তর্জাতিক প্রতিপত্তি দ্রুত আরও অনেক না ছড়াইবার কোনও কারণ নাই। বিশ্বদুনিয়ার নিকট ইহা অতীব দুঃসংবাদ। আই এস তো কেবল জঙ্গি ইসলামের উদ্ধত প্রকাশ নয়, ইসলামের নামে নিগ্রহ ও নির্যাতনের দুর্বিষহ প্রচারক। সভ্যতার শত্রু বলিয়া ইহাদের অভিহিত করিলে এতটুকু অত্যুক্তি হইবে না।
কিন্তু এই দ্রুত প্রসারের সঙ্গে খলিফা-ঘোষণাটির যোগ আছে কি? গুরুতর প্রশ্ন। জটিলও বটে। ইহার যথার্থ উত্তর দিবার সময় হয়তো এখনও আসে নাই। তবে একটি কথা ঠিক। ইসলামকে একটি রাজনৈতিক লক্ষ্যে পরিণত করিবার যে আয়োজন অনেক কাল হইতেই শুরু হইয়াছে, সেই রাজনৈতিক ইসলামের কার্যক্রম কিন্তু আই এস-এর ঘোষণায় একটি অতিরিক্ত মাত্রা পাইয়া গিয়াছে। সত্যই এক ধর্মীয় প্রধানকে রাজনৈতিক প্রধান করিয়া তোলা, এবং সকল অধীন অঞ্চলকে সরাসরি সেই রাজনৈতিক শাসনের অঙ্গীভূত করিবার লক্ষ্যে খলিফার শাসন মধ্যযুগীয় ধর্মবিভেদ ও দমনপীড়নের ইতিহাসকে ফিরাইয়া আনিবার ন্যক্কারজনক প্রয়াস। নব্বই বৎসর পর, অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে খলিফা-রাজের অবসানের পর এই প্রথম রাজনৈতিক ইসলাম এমন মাত্রায় পৌঁছাইল। ধর্মান্ধ এবং ধর্মভীরু, অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত, হতদরিদ্র কিংবা উচ্চাশী মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে খলিফার এই প্রত্যাবর্তনের আকর্ষণ রীতিমত জোরদার। তাহাদের চোখে ইহা বিগত গরিমার পুনরুদ্ধার, বিস্মৃত স্বপ্নের বাস্তবায়ন, গল্পে-শোনা প্রবাদে-জানা অতীত সম্পন্নতার ছবি।
সম্ভবত ইহাই আই এস-এর উদ্দিষ্ট ছিল। জনসমর্থনের সহিত জনপ্রিয়তা বাড়াইবার পদ্ধতি হিসাবেই তাহারা খলিফার পুনরাবিষ্কার ঘটাইয়াছিল। তবে কিনা, রাজনৈতিক ইসলামকে তো পশ্চিম এশিয়ার বৃহত্তর রাজনীতি-চিত্রটির সহিতও মোকাবিলা করিতে হইবে। সুন্নি-গোষ্ঠীয় এই জঙ্গি বাহিনীর বিরুদ্ধে শিয়া বিক্ষোভ তীব্র, যাহা ইরান ও সিরিয়ায় ব্যাপ্ত। এই পরিস্থিতিতে ইরান ও আরবের দ্বিমেরু ক্ষমতাদ্বৈরথের মধ্যে আই এস-এর উত্থানে কাহার স্বার্থ কী ভাবে রক্ষিত কিংবা বিঘ্নিত হইবে, তাহার উপরও আই এস-এর ভবিষ্যৎ নির্ভর করিতেছে। কে না জানে, ধর্ম নয়, সন্ত্রাস নয়, রাজনীতির ফাঁদ পাতা ভুবনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy