আমাদের পাড়াতেই দশ ফুট বাই দশ ফুট খুপরি ঘরে তাকে দেখছি দশ বছর। স্বামী মজুর, ছেলে স্কুলে পড়ে, সে দু-একটি ফ্ল্যাট বাড়ির সিঁড়ি-ছাত ধোয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কোন গাঁয়ে তাদের পারিবারিক জমি ভাগ হতে হতে সম্বলহীন দশা। তাই শহরে খেটে খাওয়ার জীবন। চলেও যাচ্ছিল। গোল বাধাল একজোড়া চপ্পল। পেট্রো উপজাত নরম চটি। প্লাস্টিক। সস্তায় পাওয়া যায়। তার স্বামী পরেছিল। পায়ে ঘা হয়ে গেল। এ হাসপাতাল সে ডাক্তার করল সাধ্য মতো, কিন্তু পা সারল না। স্বামী এখন ঘর-বসা। সেই মেয়েটি এখন দশ বাড়ির পরিচারিকা। তার লাবণ্য গিয়েছে। ভূতের মতো খাটে। হাতে-পায়ে হাজা। পড়া ছাড়িয়ে ছেলেকে রোজগারে লাগিয়েছে। ‘শিশুশ্রমিক’ সংক্রান্ত আইন সম্পর্কে অবহিত নয় সে। প্রধানমন্ত্রীর দু’লাখি জীবনবিমাও জানে না, জানে না স্বাস্থ্যক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর এন্তার খয়রাতিও। যদি জানত, আরও লক্ষ জনতার মতো তার মনেও সম্ভবত এই প্রশ্ন উঠত না খয়রাতি কি ভাল? জনগণের টাকা জনগণকেই দান দিয়ে মাহাত্ম্য লুণ্ঠন কি প্রতারণা নয়? সরকারি অর্থের অপপ্রয়োগ দণ্ডনীয় অপরাধ নয় কি? কোনও দুর্ঘটনা হওয়া মাত্র ক্ষতিপূরণের সরকারি প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলা এবং অচিরেই তার বিস্মরণ কি রাজনৈতিক দুরাচার নয়?
আসা-যাওয়ার পথে, মহাত্মা গান্ধী রাস্তার ফুটপাথে একটি জুতোর দোকান প্রত্যহ দেখি আর নিরাময়ের ঊর্ধ্বে চলে যাওয়া চর্মরোগটির কথা মনে পড়ে। বহু লোক সেই জুতোর দোকানে ভিড় করে। প্লাস্টিকের উগ্র গন্ধে নাক জ্বলে। কিন্তু লোকের সে-সব সয়ে গেছে। সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে, আর কী চাই! কৌতূহলে হাতে তুলে দেখি সেই সব পাদুকা। কোনও মার্কা নেই। কোনও নথিভুক্ত কোম্পানির ছাপ নেই। কোথায় কোন গলিতে, কোন বস্তিতে অবৈজ্ঞানিক ও বেআইনি পন্থায় এগুলি তৈরি হয়! ক্রেতা সুরক্ষার সরকারি বিজ্ঞাপনকে কাঁচকলা! তৈরি যখন করছে খেটেখুটে, কতিপয় লোক ‘করে খাচ্ছে,’ জুতোশিল্পের প্রসার ঘটাচ্ছে, মাথা ঘামাবার প্রয়োজন কী! একে তো ঘোর কলি পেরিয়ে আমরা অবিনশ্বর প্লাস্টিক যুগে এসে পড়েছি, স্বাস্থ্যপরিষেবা-সচেতন মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যকে শিল্পসমৃদ্ধ করতে, মারাত্মক রোগাক্রমণ ও দূষণ সম্ভাবনা সত্ত্বেও যত্রতত্র প্লাস্টিক কারখানার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নিলে কিছুই বলার থাকে না। তাঁর একশো শতাংশ কাজ সারা। তাঁর পরীক্ষার খাতা তিনিই দেখেন।
স্বাধীনতার ৬৭ বছর পরেও এ দেশের অধিকাংশ মানুষ কেবল ‘বেঁচে থাকে।’ কী ভাবে বাঁচার কথা তা ভাবতে শেখানো হয় না। মহানগরের চলপথে টালি খাবলা মেরে তুলে পথের ধারে হকারদের বসার মঞ্চ। কোনও নিবারণ নেই। করে খাওয়ার বিবিধ বেআইনি পন্থা থেকে প্রশাসন তাদের নিরস্ত করতে চায় না, কারণ তা হলেই সেই জবাবদিহি করতে তারা বাধ্য হবে: এ কাজ না করলে কোন কাজ? কোন ন্যায়সঙ্গত সুযোগ? দক্ষতা ও যোগ্যতা যাতে অর্জন করতে পারে সব স্তরের জনগণ, তার জন্য পরিকাঠামো? নেই। অতএব বেআইনি ক্রিয়াকলাপে ইন্ধন জোগানো। উত্সাহিত করা জবরদখলে, সমাজবিরোধিতায়। তৃণমূল সরকারের চার বছর অতিক্রান্ত। বোঝা গেল না এই সরকারের শিল্পনীতি কী? বাণিজ্যনীতি? কৃষিভাবনা? শিক্ষা? স্বাস্থ্য পরিষেবা? নিখরচায় সরকারি হাসপাতালের দরজা দেখিয়ে দিলেই কি জনস্বাস্থ্য পরিষেবা যথাযথ হয়?
স্বাস্থ্য পরিষেবার কথাই যখন উঠল, ওই মহাত্মা গান্ধী ও তত্সংলগ্ন রাস্তাতেই কাটাফলের আঢাকা ও সারাদিনব্যাপী ব্যবসা দেখে মূর্ছা যাওয়ার কিছু নেই, কারণ কাছেই কলকাতা মেডিকাল কলেজ, সেখানে নিখরচায় চিকিত্সা, কিন্তু ন্যায্য দামে ওষুধের দোকানে শূন্য তাক। স্টক না থাকলে তাঁরা কী করবেন! আর তেমন-তেমন দামি ওষুধ যদি ওই দোকানেও মহার্ঘ হয়, তাতেই বা কী করা যাবে! ন্যায্য মূল্য কে নির্ধারণ করবে?
নেই-কাজের সংবাদ মাধ্যম কেবল আছে অর্থহীন বিষয় নিয়ে হইহই করতে! আর সরকার? হাসপাতালে ওষুধের রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথ তাপমাত্রায় হচ্ছে কি না, সেটা নিয়েও যদি সরকারকে মাথা ঘামাতে হয় তবে মন্ত্রী-আমলারা কখন জলসা দেখবেন? ক্রিকেট নিয়ে মাতবেন কখন? কখন সঙ্গী-সাথী নিয়ে শোর মচিয়ে শিল্প-শিল্প খেলতে বিদেশ যাবেন! চার বছর ধরে এই যে মহাকরণে আর নবান্নে হাতুড়ি মেরে সুসংস্কৃত পশ্চিমবঙ্গ গড়ে তোলা হল, বঙ্গালঙ্কার বিতরণ করে গুণিজনদের মেরুদাঁড়াটি ভাঙা হবে কখন? ভোট এসে গেল। বিদ্বজ্জনদের রাস্তায় নামাতে হবে না? তাঁরাই তো বলবেন, চৌত্রিশ বছর পর বাংলার অমলধবল পালে হাওয়া লেগেছে কি না! এমতাবস্থায় প্লাস্টিক দূষণ, ভাঙা রাস্তা, নিরীহ ফলবিক্রেতা, কর্তব্যরত সরকারি কর্মীরা মরলে বা আহত হলে ক্ষতিপূরণ, এ-সব নিয়ে ভাবা যায়? কিছু লোক চিরকেলে শুচিবায়ুগ্রস্ত কাঁদুনে। ধর্ষণ হলেও কাঁদে, নেতার হাতে পুলিশ মার খেলেও, শিক্ষাক্ষেত্রে নব্যনীতি প্রণয়ন হলেও কাঁদে, আলুচাষি মরলেও। অত আলু ফলাতে কে বলেছে? সরকার, না মুখ্যমন্ত্রী?
যা বলা হয়েছিল, কাজ তো তার চেয়ে বেশিই হচ্ছে। ক্ষমতায় আসার আগে তৃণমূল মুখপত্রে কিন্তু একুশ হেলিপ্যাড বলা ছিল না। ওটা রাজ্যবাসীর ফাউ পাওনা। কোচবিহারের বিমানবন্দরের মতো এগুলোও বেশ বার বার উদ্বোধন হবে, বিকল হবে, অচল হবে, আবার পরীক্ষা-উড়ান, আবার উদ্বোধন, আবার জলসা, আবার মজা!
এর মধ্যে যদি প্রশ্ন ওঠে, এই যে সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কলকাতা মেডিকাল কলেজ আজও এখানে অপারেশন থিয়েটার অকুলান কেন? একই ওটি-তে হাড় জোড়া, পিত্তাশয় কর্তন, ফোঁড়া কাটা থেকে আপাদমস্তকের ধোলাই, সেলাই, সারাই চলে কেন? কেন হাসপাতালের চিকিত্সকদের খেয়োখেয়ি ঝগড়াঝাটি করে স্ব-স্ব রোগীর জন্য ওটি দখল করতে হয়? ওটি বললে চলবে না। শহরতলির হাসপাতালে গরু চরবে, বারান্দায় কুকুর শুয়ে থাকবে, শহরের হাসপাতালে ইঁদুর-বেড়াল লড়াই করবে। জরুরি বিভাগের ঘাড়ের ওপর গড়ে উঠবে গণশৌচালয়! রক্তাভাবে রোগী মরবে, ওটি না পেয়ে পচন ধরবে রোগীর দেহে, আইসিইউ বা আইটিইউতে জায়গা না পেয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে মরবে। মরার জন্যই তো জন্ম! আর কাজ করার জন্যই জীবন। সে কাটা ফল বিক্রিই হোক, প্লাস্টিকের জুতোই হোক কী তেলেভাজা! সব শিল্প! দেখার জন্য শিল্পীর দৃষ্টি থাকা চাই! গৃহকর্মশিল্পের অন্যতম বাহক ওই মেয়েটি রোজ সেই কথা মনে করিয়ে দেবে আমাদের। যে ভোর পাঁচটায় কাজে নামে, দিনভর ঝি-গিরি করে বেলা পাঁচটায় ভাত খেতে বসে। আবার কাজে যায়। রাত এগারোটায় ঘরে ফেরে। একজোড়া চপ্পল তার জীবনকে এই মার মেরেছে। দারিদ্র, অস্বাস্থ্য, অশিক্ষা আছে, বললেই হল! শিল্প নেই, উন্নতি নেই, কৃষির ভরসা নেই, কুত্সা গাইলেই হল! খালের পচা জলে মেঘের ছায়া পড়লেই বা কী!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy