নাবালক কি সব সময়েই নাবালক, না ক্ষেত্রবিচারে? এই গোড়ার প্রশ্নটিই তুলিতে চাহিয়াছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। কথাটি উঠিয়াছে দিল্লির নির্ভয়া-কাণ্ডের বিচারের প্রেক্ষিতে। বর্তমান জুভেনাইল জাস্টিস আইন অনুযায়ী আঠারো বছরের কমবয়সিরা নাবালক হিসাবে গণ্য, এবং তাহাদের ক্ষেত্রে বিচারের মাপকাঠিটি তুলনায় অনেকখানি লঘু। বর্তমান মাপকাঠি অনুযায়ী ওই ভয়াবহ ঘৃণ্য ঘটনাটিকে সাকেত-এর ফাস্ট ট্র্যাক আদালত দুর্লভের মধ্যেও দুর্লভতম স্থির করিয়াও ছয় অপরাধীর এক জনকে কোনও গুরু শাস্তি দিতে পারেন নাই, কেননা ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে তাহার আঠারো বৎসর পূর্ণ হইতে আর কয়েক মাস বাকি ছিল! সে দিনের নারকীয় অত্যাচারের অন্যতম প্রধান হোতা হওয়া সত্ত্বেও তাহাকে জুভেনাইল হোম অর্থাৎ সংশোধনাগারে তিন বৎসরের জন্য পাঠাইয়া দেওয়া ব্যতীত আর কিছু করিবার থাকে নাই। স্বভাবতই দেশ জুড়িয়া অভিযোগ উত্তাল হয়: এমন অপরাধ যাহারা করে, তিন বৎসরে সংশোধনাগার তাহাদের কী করিতে পারিবে? বিপরীতে নাবালকত্বের শারীরিক ও মানসিক গঠনের বিশিষ্টতা লইয়া শিশু অধিকার ও মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি শোরগোল তোলে।
সম্প্রতি এই তর্ক আবার উশকাইয়া দিয়াছেন নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী মেনকা গাঁধী। তিনি দাবি করিয়াছেন, নাবালকদের ক্ষেত্রে পার্থক্য করা বন্ধ হউক, কেননা এই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে পঞ্চাশ শতাংশই নাবালক! জাতীয় অপরাধ ব্যুরোর তথ্য অবশ্য বলিতেছে, মন্ত্রীর তথ্য নির্ভুল নয়। তথ্যটি বরং এই যে, নাবালক অপরাধের পঞ্চাশ শতাংশের অধিক, বস্তুত চৌষট্টি শতাংশ, সংঘটিত হয় ষোলো হইতে আঠারো বছরের তরুণদের দ্বারা। এই ধরনের ভ্রান্তি অবশ্যই অত্যন্ত অনুচিত, বিশেষত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পক্ষে। কিন্তু তাহাতে নিশ্চয়ই বিতর্কের গুরুত্ব কমে না। সেই গুরুত্ব মাথায় রাখিয়াই সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য, নাবালক অপরাধের প্রসঙ্গটি পুনর্বার আইনসভায় আলোচিত হওয়া দরকার। জুভেনাইল জাস্টিস আইনটিকে আরও কঠোর করা দরকার।
আইন কঠোরতর করিবার পথটি কী? আঠারো বৎসরের বদলে বয়সসীমা নামাইয়া ষোলো বৎসর করা? কিন্তু এই সংস্কার এক দিক দিয়া অর্থহীন নয় কি? ইহার পর যদি পনেরো বৎসরের কোনও কিশোর এই ধরনের ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত করে, তবে একই প্রশ্নের জালে আবার এক বার জড়াইতে হইবে না? বরং সর্বোচ্চ আদালত যে ইঙ্গিত দিতেছে, সে বিষয়ে তলাইয়া ভাবা দরকার। বয়স নহে, অপরাধের প্রকৃতিই আইনের ভরকেন্দ্র হওয়া উচিত। অপরাধের গুরুত্ব বিচার করিয়া তবেই শাস্তি নিরূপণ করা হউক। সুপ্রিম কোর্ট যথার্থ তুলিয়াছে, অপরাধীর বিচারে কি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ার মতো অন্ধ ভাবে একটি বিশেষ তারিখ কিংবা বিশেষ বছরের মাপকাঠি প্রযোজ্য হইতে পারে? নির্ভয়া-কাণ্ডের মতো ঘটনা যাহারা ঘটাইতে পারে, তাহাদের বয়স যাহাই হউক, আদৌ কি তাহাদের নাবালক বলিয়া গণ্য করা চলে? এই প্রশ্ন আইনসভারই বিবেচ্য। আলোচনা ও বিতর্কের ভিত্তিতে আইন সংশোধনের কাজ তাঁহাদেরই। তবে, এখানে একটি পুনশ্চ অবশ্য-উচ্চার্য। যে ভাবেই আইন সংশোধন হউক না কেন, অপরাধের গুরুত্ব ও প্রেক্ষিত কোনও আইনের মধ্যেই সম্পূর্ণ ভাবে আনা সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত গুরুত্ব নির্ধারণের কাজটি বিচারবিভাগেরই। সুতরাং রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগকে হাত মিলাইয়া এমন গুরুতর একটি সামাজিক প্রশ্নের মীমাংসা করিতে হইবে। গত্যন্তর নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy