পা নাগড় আজ যাহা বুঝিতেছে, পশ্চিমবঙ্গ কাল তাহা বুঝিবে কি? পানাগড় বাজারের ব্যবসায়ীরা রাস্তা চওড়া করিবার জন্য জমি ছাড়িতে নারাজ ছিলেন। বছরের পর বছর প্রধানত তাঁহাদের বাধায় দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ওই অঞ্চলে তাহার নির্ধারিত প্রসার পায় নাই, ফলে এই দ্রুতপথটিতে সেখানে বিপুল যানজট নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, দুর্ঘটনাও। সরকার তত্পর ও কঠোর হইলে এই বাধা অতিক্রম করা যাইত, বিশেষত সংশ্লিষ্ট জমির অধিকাংশই যখন খাস জমি, জবরদখল হইয়া আছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে জবরদখল সর্বশক্তিমান। পানাগড়ের বাধা বামফ্রন্ট আমলে সরানো হয় নাই, আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজত্বে তো শত যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র ভূমি। সুতরাং এক্সপ্রেসওয়ে পানাগড়ে পৌঁছাইয়া সহসা শম্বুকসরণি। কিন্তু অবশেষে বাধা সরিয়া যাইবার আশা দেখা দিয়াছে, ব্যবসায়ীরা জমি ছাড়িতে রাজি। কারণটি সহজ। ওই সংকীর্ণ রাস্তাটুকু পাশ কাটাইবার জন্য একটি বাইপাস তৈয়ারির পরিকল্পনা অবশেষে রূপায়িত হইতেছে, এবং তাহাতেই তাঁহারা শঙ্কিত। কারণ বিকল্প রাস্তা খুলিলে সমস্ত যানবাহন সেই পথেই যাইবে, ফলে তাঁহাদের বেসাতি বিপন্ন হইবে। সুতরাং বোধোদয়।
ঘটনাটি প্রতীকস্বরূপ। পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তর সত্যের প্রতীক। এই রাজ্য দীর্ঘকাল যাবত্ স্থিতাবস্থার দাসত্ব করিয়া আসিতেছে। জমি না ছাড়িবার অনমনীয় নীতি এই দাসত্বের এক চরম নিদর্শন, কিন্তু এমন নিদর্শন আরও অনেক দেখা গিয়াছে। যথা, শিল্পের আধুনিকীকরণে ক্রমাগত বাধা সৃষ্টির সুদীর্ঘ ঐতিহ্য। ব্যাঙ্ক বা অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে কম্পিউটার ব্যবহারের বিরুদ্ধে এক কালে ঠিক এই একই ধরনের ‘জমি না ছাড়িবার’ জেদ দেখিয়াছে পশ্চিমবঙ্গ। আজ যেমন কৃষকের স্বার্থরক্ষার অজুহাত দেওয়া হইতেছে, সে দিন তেমনই শ্রমিক-কর্মীদের স্বার্থরক্ষার ধ্বজা উড়িয়াছিল। পরিণাম? পশ্চিমবঙ্গ হইতে শিল্পই উধাও হইয়া গিয়াছে। এ রাজ্যে আজ আর ট্রেড ইউনিয়নের দৌরাত্ম্যের সেই পরিচিত কাহিনিগুলি শোনা যায় না, কারণ দৌরাত্ম্য করিবার মতো পরিসরই নাই। কমলবনটিই যদি না থাকে, মত্তহস্তীরা দাপাইবে কোথায়?
কৃষি বা শিল্পের দৃষ্টান্তগুলি বিচ্ছিন্ন নহে, একই ব্যাধির প্রকাশ। ‘চলিবে না’-র ব্যাধি। এক কালে বাঙালি ‘আজ হরতাল আজ চাকা বন্ধ’ গাহিয়া আত্মপ্রসাদ অর্জন করিয়াছিল, তাহার পরিণামে চাকা বন্ধই হইয়া গিয়াছে, পশ্চিমবঙ্গে আজ আর কিছুই চলে না, অটো রিকশ এবং হাওয়াই চপ্পল ব্যতীত চলিবার মতো বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নাই। পৃথিবী, এমনকী বাকি ভারতও এই রাজ্যকে বাতিলের দলে ফেলিয়াছে, তাহার দুর্ভাগ্য এবং দুর্দশা লইয়াও আজ আর কেহ মাথা ঘামায় না। ইহা বিশেষ লক্ষ করিবার বিষয় যে, পশ্চিমবঙ্গ এবং তাহার বাঙালিকে লইয়া দেশে ও দুনিয়ায় নিন্দার প্রকোপ ক্রমশ কমিয়া আসিয়াছে— নিন্দিত হইবার জন্যও প্রথমে প্রাসঙ্গিক হইতে হয়। পশ্চিমবঙ্গ অপ্রাসঙ্গিক। পানাগড়ের ‘না’-বাদীরা অপ্রাসঙ্গিক হইবার ভয়ে ‘হ্যাঁ’ বলিতেছেন। পশ্চিমবঙ্গ এখনও নেতির সাধক। তাহার রাজনীতির নায়কনায়িকারা সেই সাধনায় নিবেদিতপ্রাণ। তাহার সমাজ তাঁহাদের পরম পৃষ্ঠপোষক। বাকি পৃথিবী এই রাজ্যকে বাইপাস করিয়া চলিয়া যাইবে, ইহাতে আর বিস্ময় কী? এবং সর্বাধিক আশঙ্কার কথা ইহাই যে, সেই সর্বজনীন উপেক্ষাও এই সমাজের টনক নড়াইতে পারিবে বলিয়া কিছুমাত্র ভরসা হয় না। প্রকৃত কূপমণ্ডূককে উদ্ধার করে, কাহার সাধ্য?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy