Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

বাকি ইতিহাস

অধিকাংশ বহুব্যবহৃত বিশেষণের মতোই যুগান্তকারী শব্দটিও সচরাচর অপব্যবহৃত। কিন্তু সমকামী বিবাহকে আইনসিদ্ধ ঘোষণা করিয়া মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়াছে, তাহাকে যুগান্তকারী না বলিয়া উপায় নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজ্যের আইন সমকামীদের বিবাহকে ইতিমধ্যেই স্বীকার করিয়াছে বটে, কিন্তু অন্যত্র তাহা অ-মান্য।

শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

অধিকাংশ বহুব্যবহৃত বিশেষণের মতোই যুগান্তকারী শব্দটিও সচরাচর অপব্যবহৃত। কিন্তু সমকামী বিবাহকে আইনসিদ্ধ ঘোষণা করিয়া মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়াছে, তাহাকে যুগান্তকারী না বলিয়া উপায় নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজ্যের আইন সমকামীদের বিবাহকে ইতিমধ্যেই স্বীকার করিয়াছে বটে, কিন্তু অন্যত্র তাহা অ-মান্য। আরও বড় কথা, সে দেশে, বিশেষত দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে, সমাজের একটি বড় অংশ এখনও সমকামিতা এবং বিবাহ, উভয় প্রশ্নেই রীতিমত রক্ষণশীল। যাঁহারা সমকামিতাকে ব্যক্তিগত পছন্দ হিসাবে মানিয়া লইতে রাজি, তাঁহাদের মধ্যেও অনেকেই সমকামীদের বিবাহ মানিতে নারাজ। বিবাহ তাঁহাদের বিচারে একটি ‘পবিত্র’ প্রতিষ্ঠান। বিষমকামী নরনারীর সহবাস এবং সন্তান প্রজনন ও প্রতিপালনের ধ্রুপদী দায়িত্ব নির্বাহের জন্য নির্ধারিত এই প্রতিষ্ঠানটিতে সমকামিতার স্থান নাই, ইহাই তাঁহাদের অভিমত। ইহার পিছনে ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের ভূমিকা বিস্তর। এই পরিপ্রেক্ষিতেই সুপ্রিম কোর্টের রায় ঐতিহাসিক, কারণ ইহার ফলে একসঙ্গে পঞ্চাশটি রাজ্যেই সমকামী বিবাহ আইনত সিদ্ধ হইল। ইহাকে যুগান্ত বলিলে অত্যুক্তি হয় না।

আদালত রায় দিলেই বিতর্কের অবসান হয় না। সুপ্রিম কোর্টের রায়টিই ‘বিতর্কিত’— নয় জন বিচারকের পাঁচ জন এই রায়ের পক্ষে, চার জন বিপক্ষে। সমাজে ও রাজনীতিতেও বিভাজন স্পষ্ট। ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আদালতের সিদ্ধান্তকে বজ্রের মতো আকস্মিক এবং শক্তিশালী বলিয়া বন্দনা করিয়াছেন, আগামী বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী হইতে দুরভিলাষী ববি জিন্দল সুপ্রিম কোর্ট তুলিয়া দিবার আহ্বান জানাইয়াছেন। তবে তিনিও নিশ্চয়ই জানেন, ইতিহাসের মুখ থাকে অতীতের দিকে, কিন্তু সে ভবিষ্যৎ অভিমুখে ছুটিয়া চলে। নিজে ছোটে না, সামাজিক আন্দোলনের তাড়না তাহাকে ছোটায়। আমেরিকায় সমকামীর অধিকারের দাবিতে আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ, ১৯৬৯ সালে নিউ ইয়র্কে কুখ্যাত ‘স্টোনওয়াল দাঙ্গা’র পরে সেই আন্দোলন নূতন মাত্রা ও তীব্রতা অর্জন করে। এক অর্থে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সেই ইতিহাসের একটি পরিণতি নিহিত। ইতিহাসের এই গতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সীমিত নহে। অনেক দেশেই সমকামীদের অধিকার স্বীকৃত হইতেছে। সম্প্রতি ক্যাথলিকপ্রধান আয়ার্ল্যান্ডে গণভোটে সমকামী বিবাহ স্বীকৃতি অর্জন করিয়াছে। যবনিকা কেবল কম্পমান নহে, অপস্রিয়মাণ।

কিন্তু অপসৃত নহে। মার্কিন সমকামীরা বিবাহের অধিকার অর্জন করিয়াছেন, সমাজজীবনের অন্য নানা পরিসরে সমান অধিকার দূর অস্ত্। বিশেষত, চাকরি, ব্যবসা এবং আবাসনের ক্ষেত্রে সমকামী তথা ‘অন্য যৌনতা’র নাগরিকরা এখনও প্রায়শই বৈষম্যের শিকার। পঞ্চাশটির মধ্যে প্রায় অর্ধেক রাজ্যে তাঁহাদের সমানাধিকার নিশ্চিত করিবার জন্য প্রয়োজনীয় রক্ষাকবচ নাই। সমকামী অধিকারের দাবিতে আন্দোলনকারী মার্কিন নাগরিক ও সংগঠনগুলি ফেডারেল অর্থাত্‌ কেন্দ্রীয় আইনে সেই রক্ষাকবচ চাহিয়া আসিতেছেন, ষাটের দশকের ‘সিভিল রাইটস’ আন্দোলনের সূত্র ধরিয়া সেই নাগরিক অধিকারের সংজ্ঞায় সমকামীদের বিশেষ স্বীকৃতির পক্ষে সওয়াল করিতেছেন। এখনও অনেক সংগ্রাম বাকি। কেবল মার্কিন দুনিয়ায় নয়, গোটা বিশ্বেই। এ দেশেও। সনাতন ভারতের আইন আজও ঔপনিবেশিক। এবং মহামান্য সাংসদরা দেশের সুপ্রিম কোর্টের অনুজ্ঞা মানিয়া কোন সুদূর ভবিষ্যতে সমকামীদের অধিকারকে সম্মান দিয়া আইন প্রণয়ন করিবেন, অন্তত তাঁহাদের আইনি নিপীড়নের আশঙ্কা হইতে মুক্ত করিবেন, বলা কঠিন, অন্তত নরেন্দ্র মোদী ও তস্য পরিবারের নিকট এ বিষয়ে প্রত্যাশা অতি ক্ষীণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE