বারুদের স্তূপ প্রস্তুত থাকিলে আগুন জ্বালাইতে একটি স্ফুলিঙ্গ যথেষ্ট। গত মাসে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক অঞ্চলে তিন ইজরায়েলি কিশোরের অপহরণ ও হত্যা সেই স্ফুলিঙ্গ সরবরাহ করিয়াছে। ঘটনার পরেই ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেন, এই অপহরণ কাণ্ড জঙ্গি প্যালেস্তিনীয় সংগঠন হামাস-এর কীর্তি এবং ইহার সমুচিত জবাব মিলিবে। ইতিমধ্যে অপহরণের ‘বদলা’ হিসাবে এক প্যালেস্তিনীয় কিশোরের অপহরণ ও হত্যাও ঘটিয়া গিয়াছে, সে জন্য তিন জন ইজরায়েলি গ্রেফতারও হইয়াছে। কিন্তু অগ্নি নির্বাপিত হয় নাই। বারুদস্তূপে বিস্ফোরণ ঘটিয়া গিয়াছে। ইজরায়েলে হামাসের রকেট হানা এবং প্রত্যুত্তরে ইজরায়েলের বিমান হইতে গাজায় বোমাবর্ষণ ও আপাতত সীমিত ভাবে স্থল-অভিযান, যাহা যে কোনও সময় তীব্রতর হইতে পারে যুদ্ধের ছকটি পুরানো। ইজরায়েল সহসা বড় আকারের স্থলযুদ্ধে অংশগ্রহণ করিতে চায় না, কারণ গেরিলা যুদ্ধে হাত-পাকানো প্যালেস্তিনীয়দের হাতে ইজরায়েলি বাহিনীর সমূহ ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তাই প্রধানত বোমাবর্ষণ করিয়া হামাসের ঘাঁটি ও সামরিক প্রত্যাঘাতের ক্ষমতা ধ্বংস করার ঘোষিত উদ্দেশ্য লইয়াই ইজরায়েলি সরকারের অভিযান।
সেই অভিযান যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের চাপেও বন্ধ করা হইবে না, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তাহা আগাম জানাইয়া দিয়াছেন। তাঁহার উপর কট্টরপন্থীদের প্রবল চাপও আছে, ইতিমধ্যেই তাঁহার বিদেশমন্ত্রী সরকারের ‘নরমপন্থা’র প্রতিবাদে সদলবল তাঁহাকে ছাড়িয়া গিয়াছেন। ফলে রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিবের আর্জি সত্ত্বেও ইজরায়েলের তরফে যুদ্ধবিরতির কোনও সংকেত নাই। গাজায় অন্তত দেড়শো প্যালেস্তিনীয় ইজরায়েলি হানায় নিহত। জনজীবন বিপর্যস্ত। রাষ্ট্রপুঞ্জের ত্রাণ-শিবিরে অন্তত ১৭ হাজার শরণার্থী। তাঁহাদের ভবিষ্যত্ সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। এমন একটা সময় এই যুদ্ধোন্মাদনা, যখন মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন প্যালেস্তিনীয় ন্যাশনাল অথরিটি এবং হামাসের মধ্যে মিলনচুক্তি সম্পাদিত হইয়াছে গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাংক লইয়া একটি অভিন্ন নির্বাচিত প্যালেস্তিনীয় সরকার গড়ার জন্য। ইজরায়েল ওই চুক্তি ও তাহার নিহিত মিলনপ্রয়াসের তীব্র বিরোধী। প্যালেস্তিনীয়দের ঐক্য তাহার কাম্য নয়। তাহার প্রধান আপত্তি, হামাস একটি জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী, তাহাকে মানিয়া লওয়া অসম্ভব।
আপত্তি অহেতুক নহে। এই গোষ্ঠী এখনও ইহুদি রাষ্ট্রের অস্তিত্বই স্বীকার করে না। তাই ইজরায়েল যদি ওয়েস্ট ব্যাংকের সহিত গাজার মিলন বানচাল করিতে চায়, তাহা অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু হামাস সম্ভবত মরিয়া, কারণ সামগ্রিক ভাবে ইজরায়েলি ও প্যালেস্তিনীয়, দুই পক্ষেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের একটি দাবি জোরদার হইতেছে, সেই শান্তির সম্ভাবনা যত বাড়িবে, জঙ্গি হামাস অপেক্ষা তুলনায় নরমপন্থী আব্বাসের প্রভাব ততই বাড়িবে। যে কোনও কট্টর জঙ্গি গোষ্ঠী যে কারণে সচরাচর শান্তিপ্রতিষ্ঠার বিরোধী হইয়া থাকে, হামাসও তাহার ব্যতিক্রম নহে। কিন্তু বাঘের পিঠে চড়িবার ব্যাধি সচরাচর আত্মঘাতী হইয়া থাকে। এত দিনে হামাসের বুঝা উচিত যে, ইজরায়েলের যুদ্ধযন্ত্রের সহিত তাহার আঁটিয়া ওঠা দুঃসাধ্য। যে কোনও সংঘর্ষে ইজরায়েলের গায়ে আঁচ না লাগিলেও শত শত, এমনকী হাজার হাজার অসামরিক প্যালেস্তিনীয় হতাহত হইতেছে। এ বারেও হামাসের রকেট হানায় ইজরায়েলি প্রাণহানি এখনও শূন্য। এই নিষ্ফল ও আত্মঘাতী যুদ্ধপ্রয়াস পরিহার করিয়া ইজরায়েলের সহিত প্যালেস্তিনীয় রাষ্ট্রের অধিকার ও সীমানা লইয়া দর-কষাকষি করাই শ্রেষ্ঠ পন্থা। জেহাদি কর্মসূচি কার্যকর করিতে গিয়া মুসলিম ব্রাদারহুড-এর কী পরিণতি হইয়াছে, প্রতিবেশী মিশর নিত্য তাহার প্রমাণ। আপস মীমাংসা কেবল প্যালেস্তাইনের নহে, হামাসেরও বাঁচিবার একমাত্র পথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy