Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

বিদেশনীতি চালকের আসনে স্বয়ং মোদী

চিন, জাপান, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: ইতিমধ্যে অনেকেই চমৎকৃত তাঁঁর নীতিতে। কিন্তু কেন? মোদী ম্যাজিকটা ঠিক কোথায়? এক কথায় বললে: দ্বিধাহীনতা। ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়চিন, জাপান, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: ইতিমধ্যে অনেকেই চমৎকৃত তাঁঁর নীতিতে। কিন্তু কেন? মোদী ম্যাজিকটা ঠিক কোথায়? এক কথায় বললে: দ্বিধাহীনতা।

তিন মাস, সুদূর অতীত। নওয়াজ শরিফ ও নরেন্দ্র মোদী। দিল্লি, ২৭ মে। ছবি: প্রেম সিংহ

তিন মাস, সুদূর অতীত। নওয়াজ শরিফ ও নরেন্দ্র মোদী। দিল্লি, ২৭ মে। ছবি: প্রেম সিংহ

শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৪
Share: Save:

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সম্পর্কে তাঁর দেশের মানুষের বিশেষ অনুরাগ না থাকলেও চিনারা তাঁকে বেশ ভালবেসেই মনে রেখেছেন। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আমেরিকা সফরের কথা উঠলে তাঁরা আজও বলেন, ‘সেই একটা সপ্তাহ, যা পৃথিবীকে পালটে দিয়েছিল।’ সম্প্রতি সাংহাই ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল প্র্যাকটিসেস-এর লিয়োউ ৎসংয়ি লিখেছেন, ‘ভারতীয় রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থী বলে মোদীর পক্ষে ভারতের ‘নিক্সন’ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি, যিনি চিন-ভারত সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন... মোদীর শাসনশৈলী এবং নীতির সঙ্গে চিনের শাসনধারার খুব সাদৃশ্য আছে।’

এক জন চিনা বিশেষজ্ঞের মুখে এমন প্রশংসা রীতিমত বিরল, কারণ এশিয়ার অন্য অনেক দেশের মতোই চিনেও সাধারণত মনে করা হয় যে, ভারত হল নানা রকম অন্তর্বিরোধে জর্জরিত একটি দেশ, যেখানে হাজার ঝামেলা লেগেই আছে। চিনারা সাধারণত ভারতকে নানা প্রসঙ্গে তুচ্ছ করেই থাকেন। যেমন, ২০১২ সালে ভারত যখন ‘চিন-ঘাতক’ অগ্নি-৫ ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়, তখন চিনের রাষ্ট্রচালিত সংবাদপত্র হুয়ানছিয়োউ শিপাও মন্তব্য করেছিল, ভারত যে ‘সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নতিতে সামগ্রিক ভাবে চিনের থেকে পিছিয়ে আছে, এটা তারই একটা স্পষ্ট নিদর্শন।’

নরেন্দ্র মোদীর বিদেশ নীতি কেবল চিন নয়, দুনিয়ার অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের চালকদেরই চমৎকৃত করেছে, তাদের মধ্যে বিশেষ ভাবে বলতে হয় জাপান, জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা। কিন্তু কেন? মোদী ম্যাজিকটা ঠিক কোথায়? এক কথায় বললে: দ্বিধাহীনতা। সাম্প্রতিক কালে ভারতের বিদেশ নীতিতে একটা দোলাচল দেখা গেছে, অনেক সময় বলা হয়েছে বিদেশ নীতি অবসাদগ্রস্ত, তার কোনও বড় লক্ষ্য নেই। অথচ ভারতের সম্ভাবনা কিছুমাত্র কম নয়। দরিদ্র দেশ হলেও ভারত পারমাণবিক শক্তিধর, তার আছে বিরাট সেনাবাহিনী, উন্নত মানের নৌবাহিনী এবং আধুনিক বিমানবাহিনী। সবচেয়ে বড় কথা, ভারতই একমাত্র দেশ যার আন্তর্জাতিক কূটনীতির মঞ্চে প্রথম সারিতে স্থান নেওয়ার সামর্থ্য আছে কিন্তু সেই স্থান সে এখনও দাবি করেনি। যখন তা সে করবে, সেটা হবে দুনিয়ার কাছে একটা স্মরণীয় মুহূর্ত। এবং বৃহৎ শক্তিগুলি সে কথা জানে। এক জন প্রত্যয়ী নেতা সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দিল্লির দরবারে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, এই ঘটনার তাৎপর্য বিশ্বের প্রধান রাষ্ট্রগুলির না বোঝার কোনও কারণ নেই। তারা জানে, এটা একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত এবং তারা এর সুযোগ নিয়ে ভারতের সঙ্গে কূটনীতির খেলায় নামতে আগ্রহী।

প্রশ্ন হল, মোদী কী ভাবে খেলবেন? এ পর্যন্ত তাঁর প্রাথমিক পদক্ষেপগুলি সতর্ক, রক্ষণাত্মক। প্রথমেই তিনি প্রতিবেশীদের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছেন। ভারতীয় শাসকরা অনেক দিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিকে অবহেলা করে আসছেন। এর অন্যতম প্রমাণ, নেপালে গত সতেরো বছরে কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী সফর করেননি। মোদী ক্ষমতায় এসেই সংকেত দিয়েছেন যে, ভারত প্রতিবেশীদের প্রতি মনোযোগী হবে, তাদের নানা রকম সুযোগসুবিধে দেবে, যাতে তাদের মনোভাব ভারতের প্রতি অনুকূল হয়। ভুটানে এবং নেপালে তাঁর অত্যন্ত সফল সফর এবং তাঁর বিদেশমন্ত্রীর বাংলাদেশ যাত্রা দেখিয়ে দিয়েছে, তাঁর অগ্রাধিকার কোথায়। আশা করা হচ্ছে, কলম্বো, মালে এবং ইয়াঙ্গনের প্রতিও অচিরেই একই মনোযোগ প্রদর্শন করা হবে।

অন্য দিকে, পাকিস্তানকে নিয়ে দিল্লি এখন অনেক কম মাথা ঘামাবে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি কারগিলে গিয়ে ছায়াযুদ্ধ বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানকে যে কঠোর বার্তা দিয়েছেন, সেটা অবশ্যই সে দেশের সামরিক কর্তাদের উদ্দেশেই, কারণ তাঁরাই পাকিস্তানের বিদেশ নীতির আসল নিয়ামক। মোদী তাঁদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভারত তাঁদের আর বিশেষ ছাড় দেবে না। পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে কথা বলার প্রতিবাদে বিদেশ সচিব পর্যায়ের বৈঠক আকস্মিক ভাবে রদ করেও দিল্লি এই পরিবর্তিত এবং কঠোর মানসিকতাই বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে। মোদীর বিদেশ নীতি সংক্রান্ত উপদেষ্টারা মনে করেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কাশ্মীরে সন্ত্রাসে মদত দিয়ে চলেছে, ক্রমাগত যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে ভারতকে প্ররোচিত করে চলেছে। মোদী সেটা চুপচাপ হজম করবেন না। ভারতের এই কঠোর প্রতিক্রিয়ার লক্ষ্য হবেন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, সেটা দুর্ভাগ্যজনক, কারণ তাঁকে নিশানা করাটা ভারতের উদ্দেশ্য নয়। বস্তুত, তিনি দু’দেশের সম্পর্ক ভাল করতেই চান, কিন্তু পরিস্থিতি তাঁর প্রতিকূল। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে আলোচনা আবার শুরু হতে পারে, কিন্তু অন্তত অদূর ভবিষ্যতে সেই আলোচনা থেকে বিশেষ কিছু পাওয়ার ভরসা নেই। মোদীর উপদেষ্টারা মনে করেন, অতীতে পাকিস্তানের পিছনে অনেক সময় নষ্ট করা হয়েছে, এ বার পাকিস্তান-কেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে বৃহত্তর পরিসরে নজর দেওয়ার সময় হয়েছে।

মোদীর কূটনৈতিক পরিকল্পনার দ্বিতীয় স্তরে নজর দেওয়া হবে বৃহৎ শক্তি এবং তাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের দিকে। চিনের সামরিক শক্তিবৃদ্ধি এবং বিভিন্ন অঞ্চলে আগ্রাসী মনোভাব এশিয়ার নানা দেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলিও এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন বোধ করছে। মোদীর ভারত এশিয়ার এই ভারসাম্যে বড় ভূমিকা নিতে পারে। এই প্রেক্ষিতেই জাপান ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সহযোগিতায় আসতে আগ্রহী। বড় দেশগুলির মধ্যে মোদী যে প্রথম জাপানেই যাচ্ছেন, সেটা তাৎপর্যপূর্ণ। অন্য দিকে, চিনের শাসকরা যে মোদীর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে ব্যগ্র, তাতেও বিস্ময়ের কিছু নেই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সহযোগিতার লক্ষ্যটি আপাতত অধরা থেকে যাবে বলেই মনে হয়, কারণ ওয়াশিংটনের বিদেশ নীতি এখন কতকগুলি নীতির ছকে বাঁধা মানবাধিকার, ধর্মাচরণের স্বাধীনতা, অস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তি হস্তান্তর ইত্যাদি প্রশ্নে অনেক বেশি কঠোর শর্ত মেনে না চললে মার্কিন বলয়ে স্থান পাওয়া দুষ্কর। তা ছাড়া, পশ্চিম এশিয়া এবং এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে প্রতিরক্ষা নীতির দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে কাল্পনিক বিভাজনরেখাটি টানে, সেটার প্রেক্ষিতে ভারতের অবস্থান ওয়াশিংটনের পক্ষে খুব একটা স্বস্তিকর নয়। আমেরিকা চায়, ভারত পুব দিকে মন দিক, মার্কিন-মিত্র পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান সহ পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে তার মাথা ঘামানোর দরকার নেই। কিন্তু পাকিস্তান তো বটেই, পশ্চিম এশিয়াও ভারতের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ-সব সত্ত্বেও মোদী বুঝিয়ে দিয়েছেন, ওয়াশিংটনের সঙ্গে তিনি সম্পর্ক ভাল রাখতে চান, তবে তার পরিধি সীমিতই থাকবে। অন্য দিকে জার্মানি নিজেকে ক্রমশই একটি ইউরেশীয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে এবং ভারতের সঙ্গে তার দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা উজ্জ্বল, কারণ ভারতকে সে এশিয়ায় সুস্থিতির পক্ষে বিশেষ অনুকূল একটি শক্তি বলে মনে করে।

ভারতের বিদেশ নীতির পক্ষে এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ সময়। লক্ষণীয়, বিদেশ দফতরের দুই মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এবং ভি কে সিংহ কেউই বিদেশ নীতির ব্যাপারে খুব গভীর চিন্তাভাবনা করেছেন বলে জানা নেই। ভি কে সিংহ তো সেনাবাহিনীর নিয়োগ সংক্রান্ত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার পর থেকে একেবারেই গুটিয়ে গেছেন, আর সুষমা স্বরাজ তাঁকে যেমন বলা হবে তেমন ভূমিকা পালন করেই সন্তুষ্ট। বিদেশ নীতি পরিচালনার আসল কাজটি করছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা। তাঁদের মধ্যে আছেন নানা কূটনীতি ও প্রতিরক্ষা বিশারদ, ভূতপূর্ব গোয়েন্দা, প্রাক্তন কূটনীতিক ও সামরিক অফিসার। তাঁরা আড়ালে থাকেন, সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। মোদী মন দিয়ে শোনেন এবং কালক্ষেপ না করে সিদ্ধান্ত নেন। এটাই নতুন সরকারের কর্মপদ্ধতি।

সুতরাং বিদেশ নীতির চালকের আসনে এখন প্রধানমন্ত্রী নিজে। তিনি ঠিক ভাবে তাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন কি না, সেটাই দেখার। এটাই আশা করব যে, শেষ বিচারে নিক্সনের সঙ্গে মোদীর তুলনাটা করা হবে নিক্সনের চিন সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতেই, তাঁর ভিয়েতনাম কাহিনির প্রসঙ্গে নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial indranil bandyopadhyay narendra modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE