Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

বিদায় নীতি

বানপ্রস্থ শব্দটি জন্ম লইয়াছে বনে প্রস্থানের ধারণা হইতে। কিন্তু, নদীর মতোই, শব্দও উত্‌সে যাহা ছিল, চলিতে চলিতে তাহা হইতে বদলাইয়া যায়, বদলাইতে থাকে কলিকাতার সুনির্মল গঙ্গাকে নীলকণ্ঠও তাঁহার জটায় ধারণ করিতে পারিতেন কি না, বলা শক্ত। বানপ্রস্থের জন্য সত্য সত্যই বনে প্রস্থানের প্রয়োজন সে কালেও হইত না, এ কালে তো তাহার উপায়ও নাই, উন্নয়নের কুঠারে অধিকাংশ জঙ্গলই সাফ হইয়া গিয়াছে, বাকি যাহা আছে তাহাও শীঘ্রই যাইবে বলিয়াই মনে হয়, অন্তত পশ্চিমঘাটের অরণ্য বাঁচাইবার জন্য মাধব গ্যাডগিল কমিটির সুপারিশ যে নরেন্দ্র মোদী মানিবেন না, তাহা সরকারি ভাবে জানাইয়া দেওয়া হইয়াছে।

শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

বানপ্রস্থ শব্দটি জন্ম লইয়াছে বনে প্রস্থানের ধারণা হইতে। কিন্তু, নদীর মতোই, শব্দও উত্‌সে যাহা ছিল, চলিতে চলিতে তাহা হইতে বদলাইয়া যায়, বদলাইতে থাকে কলিকাতার সুনির্মল গঙ্গাকে নীলকণ্ঠও তাঁহার জটায় ধারণ করিতে পারিতেন কি না, বলা শক্ত। বানপ্রস্থের জন্য সত্য সত্যই বনে প্রস্থানের প্রয়োজন সে কালেও হইত না, এ কালে তো তাহার উপায়ও নাই, উন্নয়নের কুঠারে অধিকাংশ জঙ্গলই সাফ হইয়া গিয়াছে, বাকি যাহা আছে তাহাও শীঘ্রই যাইবে বলিয়াই মনে হয়, অন্তত পশ্চিমঘাটের অরণ্য বাঁচাইবার জন্য মাধব গ্যাডগিল কমিটির সুপারিশ যে নরেন্দ্র মোদী মানিবেন না, তাহা সরকারি ভাবে জানাইয়া দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু প্রকৃত বানপ্রস্থ বনে নয়, মনে। একটি সময়ের পরে কর্মক্ষেত্র হইতে নিজেকে সরাইয়া লওয়ার মানসিকতাই তাহার চালিকা শক্তি, তাহার ধর্ম। আধুনিক পৃথিবীতে কর্মজীবনে অবসর গ্রহণের ধারণাটি ইহার সমতুল। একটি বয়স অবধি কাজ করিবার পরে মানুষ অবসর লইয়া থাকে, তাহার পরে অবসরজীবন। অবসর মানেই যে নিষ্ক্রিয়তা বা আলস্য, তাহা নহে, বস্তুত এ কালে যখন স্বাভাবিক জীবনসীমা বিস্তর বাড়িয়াছে, কর্মক্ষমতাও, তখন অবসরজীবনকে সক্রিয় এবং ফলপ্রসূ করিবার সুযোগ অনেক বেশি। কিন্তু অবসরের প্রয়োজন ফুরায় নাই। প্রত্যেকটি কর্মক্ষেত্রেই নূতনকে স্থান ছাড়িয়া দিয়া পুরাতন বিদায় লইবে, ইহাই সঙ্গত, ইহাতেই সেই ক্ষেত্রটিতে নূতন প্রাণের সঞ্চার হইতে পারে।

এ বিষয়ে অন্য বিবিধ কর্মপরিসরের সহিত রাজনীতির একটি বড় তফাত ঘটিয়া গিয়াছে, বিশেষত ভারতে। এ দেশে রাজনীতিকদের স্বাভাবিক অবসর নাই। বয়স হইয়াছে, অতএব সরিয়া দাঁড়াইতেছি এমন কথা ও সেই অনুসারে কাজের নমুনা এ দেশে সম্পূর্ণ বিরল না হইতে পারে, কিন্তু অতিমাত্রায় দুর্লভ। এ বিষয়ে বহুদল ও বহুমতে বিভাজিত ভারতে কোনও ব্যতিক্রম নাই, দলমতনির্বিশেষে মন্ত্র একটিই: যত দিন বাঁচি তত দিন রাজনীতি করি। ইহা কেবল প্রবীণ রাজনীতিকদের ব্যক্তিগত ক্ষমতাভিলাষের দুর্মরতা নহে, ভারতীয় রাজনীতি ইহাকে মানিয়াও লইয়াছে। রাজনীতি সমাজ হইতেই জাত। ভারতীয় সমাজে বয়স্কতন্ত্র মজ্জাগত, বয়সজনিত প্রবীণতাকে এই সমাজ প্রজ্ঞার সমার্থক বলিয়া মনে করে, তাহার রাজনীতির পরিসরেও অতএব সত্তর আশি নব্বইয়েরা দলে দলে নট-আউট।

এই প্রেক্ষিতেই ভারতীয় জনতা পার্টির সংসদীয় বোর্ডের পুনর্গঠন বিশেষ অর্থপূর্ণ। অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবাণী এবং মুরলীমনোহর জোশীর নাম নূতন বোর্ড হইতে বাদ দেওয়ার পিছনে দল বা পরিবারের অন্তর্নিহিত টানাপড়েন কী ভাবে কাজ করিয়াছে, সে বিষয়ে বিস্তর জল্পনা চলিতেছে এবং চলিবে, ভারতীয় রাজবৃত্তে জল্পনা চিরকালই উচ্চফলনশীল। কিন্তু সেই ক্ষুদ্র আবর্তে প্রবেশ করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, এই সিদ্ধান্তের বৃহত্‌ তাত্‌পর্য ওই অবসরের নীতিতে। আডবাণী (৮৬) বা জোশী (৮০) যদি স্বাভাবিক ভাবে সেই নীতি পালন করিতেন, তাহা হইলে আজ তাঁহাদের দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক গোষ্ঠী হইতে ‘বাদ পড়িতে’ হইত না, কারণ তাঁহারা অনেক আগেই ‘সময় হইয়াছে’ বলিয়া বিদায় লইতেন। ইহার অর্থ তাঁহাদের গুরুত্ব বা অবদানকে ছোট করিয়া দেখা নহে। তাঁহারা দলের বরিষ্ঠ নেতা। তাঁহাদের অভিজ্ঞতা বিপুল। তরুণতর প্রজন্মের নায়কদের অবশ্যই তাঁহাদের নিকট অনেক কিছু জানিবার আছে, বুঝিবার আছে। কিন্তু সে জন্য তাঁহাদের সক্রিয় রাজনীতিতে থাকিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন ছিল না। অথচ প্রথমে লোকসভা নির্বাচনের এবং পরে মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তুতিপর্বে তাঁহাদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা কেবল প্রকট নহে, দৃষ্টিকটু ঠেকিয়াছে। ক্ষমতার ভাগ পাইবার দুর্মর বাসনা এমন ভাবে বিজ্ঞাপিত হইলে বয়সের গৌরব বাড়ে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE