রঘুরাম রাজন বলিয়াছেন, অতএব অদূর ভবিষ্যতে মহামন্দার সম্ভাব্যতা বাড়িয়া গেল, এমন সরলীকরণ বিপজ্জনক। সত্য, যে কতিপয় অর্থনীতিবিদ ২০০৮ সালের মন্দার পূর্বাভাস করিতে পারিয়াছিলেন, রাজন তাঁহাদের মধ্যে অন্যতম। ইহাও সত্য যে তখন গোটা দুনিয়া সেই সতর্কবার্তায় কর্ণপাত করে নাই। কিন্তু, এই বার মাত্রাধিক গুরুত্ব দিয়া আগের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হইবে না। বরং, ভিন্নতর বিপদ তৈরি হইতে পারে। মহামন্দার পূর্বাভাস কে করিতেছেন, তাহা অপেক্ষা অনেক বেশি জরুরি প্রশ্ন হইল, সত্যই কি বিভিন্ন সূচক মন্দার উপযোগী হইয়া আছে? সত্যই কি গোটা দুনিয়ায় অর্থনৈতিক উৎপাদনের পরিমাণ বিপজ্জনক ভাবে কমিয়া যাইতে পারে, অর্থনীতিগুলিকে প্রবল বেকারত্ব গ্রাস করিতে পারে? এবং, এই প্রশ্নগুলির উত্তর সন্ধানের সময় স্মরণে রাখা প্রয়োজন, যাহাকে গ্লোবাল সার্কিট অব ক্যাপিটাল বা আন্তর্জাতিক পুঁজির বৃত্ত বলা হয়, দুনিয়ার প্রায় সব দেশই তাহার অন্তর্গত। এবং, ২০০৮ সালের ধাক্কায় ভারতের ন্যায় দেশেরও অভ্যন্তরীণ শক্তি কমিয়াছে। ফলে, বড় অর্থনীতিগুলির কোনওটিতে ফের মন্দা মাথাচাড়া দিলে এই বার তাহা আরও বেশি ছোঁয়াচে হইবে। অর্থাৎ, মহামন্দার সম্ভাবনাটি উড়াইয়া দেওয়ার উপায় নাই।
অর্থনীতির অবস্থাও সুবিধার নহে। গ্রিসের ঋণ সংকটের কোনও সুষ্ঠু সমাধান এখনও খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। অদূর ভবিষ্যতে মিলিবে, সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। শুধু গ্রিস নহে, কার্যত জার্মানি ব্যতীত ইউরো অঞ্চলের কোনও দেশের অর্থনীতিই এখন স্বাস্থ্যবান নহে। তাহাই সংকটটিকে তীব্রতর করিতেছে। ইউরো অঞ্চলের অর্থনীতি টালমাটালই থাকিবে। ইউরো অঞ্চলটিই আর থাকিবে কি না, সেই আশঙ্কাও রীতিমত বাস্তব। সেই ধাক্কা বিশ্ব অর্থনীতির গায়ে আসিয়া লাগা নিতান্ত সময়ের অপেক্ষা। বিভিন্ন শেয়ার বাজারের প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট, বিনিয়োগকারীরা ইউরোপের দিকে তাকাইয়া আছেন। অস্থিরতা বাড়িবার সম্ভাবনা দেখিলেই তাঁহারা লগ্নির রাশ টানিবেন। লগ্নিতে টান পড়িলেই তাহার প্রভাব পড়িবে কর্মসংস্থানের উপর, এবং তাহাতে ভোগব্যয় কমিবে। তাহাতে জিডিপি-র বৃদ্ধির হারে ধাক্কা লাগিবে, এবং সেই ধাক্কায় বিনিয়োগ আরও কমিবে। অন্য দিকে, পশ্চিম এশিয়ার অস্থিরতাও সম্ভবত কমিবার নহে। এই অস্থিরতাও বিনিয়োগের শত্রু। পাশাপাশি, এই অঞ্চলের অস্থিরতা আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামকে অস্থির করিয়া তুলিতে পারে। অর্থাৎ, আর্থিক বিপর্যয়ের পরিবেশ তৈরি হইয়াই রহিয়াছে।
প্রশ্ন হইল, সেই বিপর্যয় কি সত্যই ‘মহামন্দা’ হইয়া উঠিতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর অর্থনীতির কেতাবে যতখানি আছে, তাহার অপেক্ষা বেশি রহিয়াছে রাজনীতির মঞ্চে। আর্থিক মন্দা এই দুনিয়া কম দেখে নাই। কিন্তু, কোন মন্দা কতখানি শক্তিশালী হইয়া উঠিবে, কোনটির প্রভাব কত বিস্তৃত হইবে, তাহা নির্ভর করে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির কর্মক্ষমতার উপর। ১৯৩০-এর আর্থিক সংকট শেষ অবধি মহামন্দা হইয়াছিল, তাহার একটি বড় কারণ ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ার পারস্পরিক সন্দেহের পরিবেশ। অন্য দিকে, ১৯৯৭-এর পূর্ব এশিয়ার সংকট অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতি করিয়াছিল, কারণ সেই সময় দুনিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল। আজ যে কারণগুলি অর্থনীতিকে টালমাটাল করিতেছে, সেগুলিই রাজনৈতিক অস্থিরতারও জন্ম দিতেছে। অতএব, সাবধান হওয়াই বিধেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy