গত তিন দশক ধরিয়া আফগানরা যুদ্ধ ও হিংসা হইতে নিজেদের রক্ষা করিতে পূর্ব সীমান্ত অতিক্রম করিয়া পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তানে আশ্রয় লইয়াছেন। এখন উত্তর ওয়াজিরিস্তানে তালিবান জঙ্গি ও আল-কায়দা জেহাদিদের ধ্বংস করিতে পাক বিমানবাহিনীর ক্রমাগত বোমাবর্ষণ সেখানে বিপরীত শরণার্থী স্রোত সৃষ্টি করিয়াছে। দেশ-ভাগের সময় হিন্দু ও শিখ উদ্বাস্তুদের লাখে-লাখে ভারতে আশ্রয় খুঁজিবার কাল হইতে অদ্যাবধি পাকিস্তানিরা কখনও শরণার্থী হন নাই। কিন্তু অন্তরীক্ষ হইতে নিরন্তর বোমাবর্ষণ নিরস্ত্র পাক জনজাতীয় পরিবারগুলিকে নিশ্চিত মৃত্যু ও ধ্বংসের মুখে ফেলিয়া দিয়াছে। পাক বাহিনীর এই হামলায় জেহাদি ও সন্ত্রাসবাদীরা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে, নিশ্চয় করিয়া বলা কঠিন। তাহাদের আত্মগোপনের রকমারি বন্দোবস্ত রহিয়াছে, বাঙ্কার, ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ ইত্যাদিতে নিরাপত্তার আশ্বাস রহিয়াছে। কিন্তু অসামরিক ওয়াজিরি জনজাতির তেমন সুরক্ষা নাই। তাঁহারা সপরিবার হতাহত হইতেছেন। এই বিপন্নতা হইতে বাঁচিতেই দলে-দলে, বস্তুত লাখে-লাখে তাঁহারা পাক সীমান্ত অতিক্রম করিয়া আফগানিস্তানের খোস্ত প্রদেশে শরণার্থী।
ইতিমধ্যেই আড়াই লক্ষ শরণার্থী সীমান্ত পার হইয়াছেন, পার হওয়ার অপেক্ষায় রহিয়াছেন আরও সাড়ে বারো লক্ষ মানুষ। অধিকাংশই পুশ্তুভাষী। সেই হিসাবে আফগানিস্তানে তাঁহারা বিদেশি বলিয়া গণ্য হইবেন না। অনেকে সহানুভূতি ও আশ্রয়ও পাইবেন। কিন্তু ১৫ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় ও ত্রাণ দিবার মতো হৃদয়বত্তা আফগানদের থাকিলেও অত ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করার পরিকাঠামো তাঁহারা কোথায় পাইবেন? বস্তুত, আফগানিস্তান রাষ্ট্রেরও সে পরিকাঠামো নাই। অচিরেই তীব্র শৈত্যপ্রবাহের বিপদ আসিতেছে। খোলা জায়গায় তাঁবু সম্বল করিয়া অনাহারক্লিষ্ট শিশু-বৃদ্ধরা কেমন করিয়া প্রাণধারণ করিবেন, সেটাই এখন এক বৃহৎ প্রশ্ন। অথচ রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্বাস্তু ত্রাণ ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত কমিশন এখনও এ দিকে সে ভাবে নজর দেয় নাই। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তো ‘জেহাদি মারিতেছি’ বড়াই করিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ হইতে আরও সামরিক সাহায্য ও সরঞ্জাম আদায়ে ব্যস্ত। বোমাবর্ষণে পাইকারি হারে ওয়াজিরিস্তানকে প্রস্তর যুগে পাঠাইবার অভিযানে তাহারা মত্ত। পরিণামে আফগানিস্তানের পূর্ব প্রদেশগুলি পাক শরণার্থীতে প্লাবিত হইতেছে।
পাকিস্তান সরকারেরও এই শরণার্থীদের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে। মনে রাখা দরকার, ইহারা পাকিস্তানেরই নাগরিক, আফগানিস্তানের নয়। তাঁহাদের যথাযথ ত্রাণ ও পুনর্বাসনের আশু বন্দোবস্ত জরুরি। এই শরণার্থীরা কেহই যোদ্ধা নহেন, নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ। তদুপরি অন্য কারণেও এই ত্রাণকাজে গতিসঞ্চার আবশ্যক। এতগুলি উচ্ছিন্ন অসহায় পরিবার যদি রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক নজরদারি কমিশনের আনুকূল্য না পায়, তবে তাহাদের মধ্যে ক্রমশ তীব্র ক্ষোভ সঞ্চারিত হওয়া স্বাভাবিক। এই ক্ষোভ কাজে লাগাইতে সক্রিয় হইবে তালিবান ও আল-কায়দার মতো জেহাদি সংগঠনগুলি। সে ক্ষেত্রে পাক বিমানবাহিনী যে উদ্দেশ্যে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে ব্যাপক বোমারু হামলা চালাইতেছে, তাহা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইবে। যদি এই সহায়সম্বলহীন শরণার্থীদের মধ্যে তালিবানি মতাদর্শের প্রতি, জেহাদি কর্মসূচির প্রতি আকর্ষণ দুর্বার হইয়া ওঠে, তাহা হইলে আর তালিবান ঘাঁটি হিসাবে ওয়াজিরিস্তানকে ধ্বংস করিয়া কী লাভ হইল?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy