Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

ব্যক্তিগত অভিমান

প্রতিষ্ঠানের স্থান ব্যক্তির উপরে। সদ্য-প্রাক্তন বিদেশ সচিব সুজাতা সিংহের বিদায়ী মন্তব্যটি অভ্রান্ত। একটিই প্রশ্ন: তিনি নিজে এই আদর্শকে তাহার প্রাপ্য মর্যাদা দিলেন না কেন? আপন ব্যক্তিসত্তাকে, সেই ব্যক্তিসত্তার আকাঙ্ক্ষা বা অভিমানকে প্রতিষ্ঠানের উপরে স্থান দিলেন কেন? পরিণামে প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেশের শাসনবিভাগের অসম্মান হইল, তাঁহার ব্যক্তিগত সম্মানও অকলঙ্ক থাকিল না। দশ বছর পরে শাসনবিভাগের নেতৃত্ব বিপরীত রাজনৈতিক শিবিরে হস্তান্তরিত হইয়াছে। ভারতীয় শাসনতন্ত্রের নেতা প্রধানমন্ত্রী।

শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

প্রতিষ্ঠানের স্থান ব্যক্তির উপরে। সদ্য-প্রাক্তন বিদেশ সচিব সুজাতা সিংহের বিদায়ী মন্তব্যটি অভ্রান্ত। একটিই প্রশ্ন: তিনি নিজে এই আদর্শকে তাহার প্রাপ্য মর্যাদা দিলেন না কেন? আপন ব্যক্তিসত্তাকে, সেই ব্যক্তিসত্তার আকাঙ্ক্ষা বা অভিমানকে প্রতিষ্ঠানের উপরে স্থান দিলেন কেন? পরিণামে প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেশের শাসনবিভাগের অসম্মান হইল, তাঁহার ব্যক্তিগত সম্মানও অকলঙ্ক থাকিল না। দশ বছর পরে শাসনবিভাগের নেতৃত্ব বিপরীত রাজনৈতিক শিবিরে হস্তান্তরিত হইয়াছে। ভারতীয় শাসনতন্ত্রের নেতা প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিসভা তাঁহার, সচিবালয়ও তাঁহার পছন্দ ও বিবেচনা অনুসারে নির্মিত হইবে, ইহাই স্বাভাবিক এবং সঙ্গত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হোয়াইট হাউসে নূতন প্রেসিডেন্ট অধিষ্ঠিত হইলে মন্ত্রী তথা সচিব এবং অন্য নানা প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি স্বাভাবিক নিয়মেই পদত্যাগ করেন, অতঃপর নবনায়ক তাঁহাদের কাহাকেও আবার বহাল করিতে পারেন, কিন্তু সে ক্ষেত্রে তিনি পুরানো জমানার অবশেষ হিসাবে থাকেন না, নূতন জমানার সচেতন চয়ন হিসাবেই আসেন। ওয়েস্টমিনস্টার-অনুসারী ভারতে তেমন বাঁধাধরা রীতি নাই বটে, কিন্তু যুক্তিটি অভিন্ন। নূতন প্রধানমন্ত্রী বা তাঁহার মন্ত্রিসভা যাঁহাকে রাখিতে উত্‌সাহী নহেন, সচিবালয় হইতে তাঁহার পত্রপাঠ বিদায় লওয়া কর্তব্য। তাহাতেই প্রতিষ্ঠানের সম্মান।

প্রধানমন্ত্রীর পছন্দ-অপছন্দ লইয়া ধোঁয়াশা থাকিলে বিভ্রাট ঘটিতে পারে। অনাবশ্যক অশোভনতাও দেখা যাইতে পারে। তেমন দৃষ্টান্ত আছে। বিশেষত আশির দশকে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী সাংবাদিকদের নিকট সহসা বিদেশ সচিব এ পি বেঙ্কটেশ্বরনকে অপসারণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিয়া যে নজির সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন তাহা নিতান্ত দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু সে সব ক্ষেত্রেও সচিব পরিবর্তনের অধিকার লইয়া যুক্তিসঙ্গত আপত্তি ছিল না, আপত্তি ছিল সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করিবার পদ্ধতি বা ভঙ্গিতে। সুজাতা সিংহের কাহিনিতে তেমন কোনও আপত্তির প্রশ্ন ওঠে না। তাঁহাকে যে প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সচিব পদে বহাল রাখিতে চাহেন না, সে কথা তিনি গোপন রাখেন নাই, বস্তুত সুজাতা সিংহ নিজেই বিদায়ের পরে অত্যন্ত অশোভন নালিশের সুরে তাঁহার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বিরাগের কথা জানাইয়াছেন। এ কথা মনে করিবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, তাঁহাকে নিজেই সরিয়া যাইবার পরামর্শ দেওয়া হইয়াছিল, এমনকী সে ক্ষেত্রে তাঁহার কাছে অন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসাবে সম্মানজনক বিকল্প ভূমিকাও প্রস্তাব করা হইয়াছিল, কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব ফিরাইয়া দেন। অর্থাত্‌, সুজাতা সিংহ প্রধানমন্ত্রীকে কার্যত তাঁহাকে অপসারণে বাধ্য করিয়াছেন।

বস্তুত, প্রধানমন্ত্রী এই পরিবর্তনের সিদ্ধান্তটি না লইলেই বরং তাহা দুর্ভাগ্যজনক হইত। নূতন বিদেশ সচিব এস জয়শঙ্করের যোগ্যতার মান যে অনেকটাই উপরে, তাহা কার্যত অবিসংবাদিত। এমনকী ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও বিদেশ সচিব পদে তাঁহাকেই চাহিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার মাথার উপরে হাই কমান্ড ছিল, অতএব তাঁহার বহু বাসনাই অপূর্ণ থাকিয়া যায়। নরেন্দ্র মোদী নিজেই তাঁহার হাই কমান্ড। তিনি জয়শঙ্করের দক্ষতা সম্পর্কে সম্যক জানেন। বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে তিনি যে প্রবল উদ্যোগ শুরু করিয়াছেন, তাহার রূপায়ণে এমন এক জন কূটনীতিককেই তাঁহার আবশ্যক, বিশেষত যে কূটনীতিক এমন দুইটি দেশ সম্পর্কে রীতিমত অভিজ্ঞ যাহারা ভারতের বিদেশ নীতির লক্ষ্য হিসাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সুতরাং সাউথ ব্লকে জয়শঙ্করের প্রবেশ অবধারিত ছিল। প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ সুজাতা সিংহ সেই সহজ সত্যটি কেন বুঝিলেন না, তাহা তিনিই বলিতে পারিবেন। ব্যক্তি হইতে প্রতিষ্ঠান যে বড়, হয়তো সে কথা তিনি বিস্মৃত হইয়াছিলেন। হয়তো ব্যক্তিগত অভিমান তাঁহাকে গ্রাস করিয়াছিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sampadkio
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE