রিচার্ড লইতংবাম, নিদো টানিয়া, সালোনি একের পর এক উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় তরুণ ভারতীয় মূল স্রোতে মিশিতে চাহিয়াছেন। তাঁহারা প্রত্যন্ত মণিপুর কিংবা অরুণাচল প্রদেশ ছাড়িয়া কেহ পড়াশুনা করিতে, কেহ বা চাকুরি করিতে দিল্লি বা বেঙ্গালুরুতে পাড়ি দিয়াছিলেন। কিন্তু ভারতীয় মূল স্রোত এই অন্ত্যেবাসী প্রান্তীয় মানুষদের কোল দেয় নাই। ‘অপর’ হওয়ার দায়ে, ভারতীয় হৃদয়পুরের সংস্কৃতির ছকে না-আঁটায় তাঁহাদের সমাজ হইতে, জীবন হইতে নির্বাসিত করা হইয়াছে। একদা যে-ভারতবীর চিত্রাঙ্গদা সন্নিধানে মণিপুর যাত্রা করিয়াছিলেন কিংবা নাগকন্যা উলূপীর পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহার ইন্দ্রপ্রস্থবাসী উত্তরসূরিরা আজ ওই সব প্রান্তজনকে পিটাইয়া মারে। নিদেনপক্ষে ‘অন্য রকম’ দেখিতে বলিয়া, অন্য লোকাচার ও সংস্কৃতি অনুশীলন করার দায়ে একঘরে করিয়া রাখে, ব্যঙ্গবিদ্রুপে বিদ্ধ করে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের যে সাধনা ভারতীয় সভ্যতাকে একদা ঋদ্ধ করিয়াছিল, বিভিন্নতাকে সন্দেহ করা এবং তাহাকে বহিষ্কার করার অপপ্রয়াসে আজ তাহা অন্তর্হিত। তাই ভারতের রাজধানীতে উত্তর-পূর্বের আরও এক যুবক নিহত।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ কিন্তু নিজেদের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক দূরত্ব ঘুচাইয়া বৈচিত্র্যময় বৃহত্তর ভারতের শরিক হইতে ব্যাকুল। কিন্তু অবশিষ্ট ভারত তাঁহাদের অপর করিয়া রাখিয়াছে। ফলে দেশের সর্বত্রই তাঁহাদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়, তাঁহারা বাধ্য হন সমজাতীয়দের সহিত একই মহল্লায় ডেরা বাঁধিতে। সন্দেহ ক্রমে অসহিষ্ণুতার জন্ম দেয়। উহারা কেন আমাদের মতো নয়, এই দাবি হইতে জন্ম লয় নিগ্রহ করার আকাঙ্ক্ষা। চেহারায় এই মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীর মানুষেরা চিনাদের অনুরূপ হওয়ায় এবং হিন্দি বলয় তথা সাবেক আর্যাবর্ত চিনের প্রতি রাজনৈতিক বৈরিতার উগ্র-জাতীয়তাবাদী মনোভাবে নিমজ্জিত থাকায় সন্দেহ বিদ্বেষে রূপান্তরিত হয়। ফলে সামান্য অজুহাতেই তাহাদের উপর নির্যাতন চালাইবার তাগিদ তীব্র হইয়া ওঠে। ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতা যদি যথার্থই বহুর মধ্যে একের সাধনা করিত, বিভিন্নতাকে আত্মসাত্ বা গ্রাস করার পরিবর্তে আত্মস্থ করার চেষ্টা করিত, তাহা হইলে কাছে আসিতে চাওয়া প্রান্তজনকে দূরে ঠেলিয়া দিত না। ভিন্নতার প্রতি সংশয়, সন্দেহ ও অসহিষ্ণুতা ভারতীয় মানসে এতটাই প্রবল যে, কিছু কাল আগে অসমের বড়ো অধ্যুষিত এলাকায় বাংলাদেশ হইতে অভিবাসী মুসলিমদের সহিত বড়োদের দাঙ্গা বাধিলে অবশিষ্ট ভারত জুড়িয়া সমগ্র উত্তর-পূর্বের জনজাতীয় মানুষরাই প্রহৃত হইতে থাকেন এবং নিরাপত্তার অভাবে উত্তর-পূর্বের ‘দেশের বাড়ি’তে ফিরিবার হিড়িক পড়িয়া যায়। কেননা ভারতীয় মূল ভূখণ্ড তাঁহাদের ‘দেশ’ হইতে অস্বীকৃত।
নরেন্দ্র মোদীর সরকার নাকি উত্তর-পূর্বের মানুষদের নিগ্রহ রোধে কড়া আইনের কথা ভাবিতেছে। ভাবনার নিহিত মনোভাবটি যে উদ্বেগের পরিচয় বহন করে, তাহা প্রশংসনীয়। কিন্তু সত্যসত্যই কি স্বতন্ত্র আইন করিয়া মঙ্গোলয়েড জনজাতিগুলির প্রতি মূল স্রোতের ভারতীয় সমাজের মানসিকতা পাল্টানো সম্ভব? আর মানসিকতার বদল না ঘটিলে, আইন তাঁহাদের কতটা নিরাপত্তা দিবে? উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে অবশিষ্ট ভারত এখনও ব্যবহারই করে। এই ভাবে ব্যবহৃত হইয়াও ওই প্রান্তলোকের জনজাতীয়রা মূল ভূখণ্ডের সমাজ-সংস্কৃতিতে শরিক হইতে আগ্রহী, তাঁহাদের কোলে টানা উচিত। পরিবর্তে ভারত তাঁহাদের বিমাতাই থাকিতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy