চার বছর আগে ফ্রান্সে আইন পাশ হইয়াছিল, বোরখা কিংবা অন্য কোনও সর্বাঙ্গ-আবরণী পোশাক পরিয়া ‘পাবলিক প্লেস’ অর্থাত্ গণস্থানে যাওয়া চলিবে না। ইউরোপের সর্বাধিক মুসলিম অধিবাসী সম্বলিত দেশটিতে জনসমাজের এক বিরাট অংশের মধ্যে এই আইন বিশেষ সন্তোষ আনিয়া দেয়। কিন্তু ইহাই একমাত্র প্রতিক্রিয়া নয়। এই নিষেধমূলক আইনটির বিরুদ্ধে চার বছর ধরিয়া ক্রমাগত বিক্ষোভ-প্রতিবাদ-সমালোচনাও দেখা গিয়াছে। বহুসংস্কৃতিবাদ ও মানবাধিকারের যুক্তিতে ইহার বিরোধিতা চলিয়াছে। অবশেষে সেই প্রতিবাদ একটি মামলায় আসিয়া ঠেকিয়াছিল। ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটস্-এ মামলা দায়ের করিয়াছিলেন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এক ফরাসি মুসলিম তরুণী। দাবি করিয়াছিলেন যে, তিনি স্বেচ্ছায় বোরখা পরিয়া থাকেন, রাষ্ট্র তাহা নিষিদ্ধ করিবে কেন? দুই দিন আগে ইউরোপীয় আদালত এই মামলার রায় প্রকাশ করিল: তরুণী পরাজিত, নিষেধাজ্ঞাটিই সমর্থিত। স্বভাবতই প্রতিবাদ আবারও উত্তাল। আবারও প্রশ্ন: কোন মানবাধিকার-বলে একটি আধুনিক দেশে পোশাকের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানো যায়। এই সমালোচনার উত্তরে সজোর প্রতিযুক্তিও শোনা যাইতেছে। সব মিলাইয়া এই গ্রীষ্মে বহু-সংস্কৃতি বনাম জাতীয় সংস্কৃতি বিতর্কে পশ্চিম ইউরোপের আবহাওয়া উত্তপ্ত।
বোরখা-নিষেধ আইনের বিরোধী মতগুলি এত দিনে পরিচিত। উদারপন্থী রাষ্ট্রদর্শনের প্রেক্ষিতে মানবাধিকারের সাধারণ নীতিতেই ধর্মাচরণে বা ব্যক্তিগত আচার-ব্যবহারে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ অগ্রহণযোগ্য, বিশেষত যখন এক জনের আচরণে অন্য কাহারও ক্ষতির সম্ভাবনা নাই। যদি কোনও মুসলিম মহিলা সর্বাঙ্গ, এমনকী মুখও, ঢাকিয়া রাস্তায় বাহির হন, তাহাতে কাহারও অস্বস্তি হইতে পারে, ‘ক্ষতি’ হইবে কেন? ইহাও প্রমাণ করা কঠিন যে বোরখা পরিধান-কারিণী নিশ্চিত ভাবে পরিবারের পুরুষদের দ্বারা আদিষ্ট হইয়াই পোশাক বাছিয়া লইয়াছেন। ধর্মীয় বিভেদের মতোই ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতির বিভেদও গুরুতর বিষয়, তাহাকে রক্ষা করা আধুনিক রাষ্ট্রের প্রাথমিক কর্তব্যগুলির মধ্যে পড়ে। আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখরাঙানির কথাই যদি ওঠে, তবে তর্ক উঠিবে, আইন প্রণয়ন করিয়া তাহা বন্ধ করা যায় কি?
অত্যন্ত মৌলিক এই সব প্রশ্নের উত্তরে ইউরোপীয় আদালত এ বার যে যুক্তির আশ্রয় লইয়াছে, তাহা তুলনায় নূতন ও অপরিচিত। সামাজিক সংযোগের যুক্তি। আধুনিক উদার সমাজের লক্ষ্য বিভিন্ন ব্যক্তির নিজস্ব পরিচয়ে ব্যক্তিকে অপর ব্যক্তিবর্গ ও সমাজের সঙ্গে যুক্ত করা। এ দিকে, যদি কোনও ব্যক্তি সর্ব ক্ষণ তাঁহার মুখের অধিকাংশ ঢাকিয়া থাকেন, তবে তাঁহাকে দেখা যায় না, তাই চেনা যায় না। তিনি অন্যদের চেনেন, অন্যরা তাঁহাকে চেনে না। এই অসম সংযোগ একটি বিশেষ ‘অসুবিধা’, আধুনিক সমাজের অনুপযুক্ত। ফরাসি রাষ্ট্র যে সমাজ প্রতিষ্ঠা করিতে চাহে, তাতে এই অসম সংযোগের স্থান নাই। বোরখার বদলে মুখোশ-পরিহিত মানুষ যদি স্কুলে কলেজে স্টেশনে পার্কে ঘুরিয়া বেড়াইত, ও মুখোশ খুলিতে অসম্মত হইত, তবে একই সমস্যা দাঁড়াইত। শেষ যুক্তিটি অবশ্যই এই রায়কে ধর্মীয় প্রেক্ষিত হইতে বাহির করিয়া আনিবার প্রয়াস। যুক্তিটি অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য, তবে বিতর্কাতীত নহে। সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে ব্যক্তির মৌলিক অধিকার অস্বীকার করা যায় কি না, ইহাই মূল প্রশ্ন। ইউরোপীয় আদালতের বিচার সেই মৌলিক প্রশ্নটিকে উড়াইয়া দিতে পারিল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy