নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সংক্রান্ত বার্ষিক কুনাট্য আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। ফের আলু-পেঁয়াজের দাম ঊর্ধ্বমুখী হইয়াছে, ফের নভেম্বর পর্যন্ত তাহা নামিবার সম্ভাবনা ক্ষীণ হইতেছে। তবে, এই বত্সর পেঁয়াজের দাম আশি টাকায় পৌঁছাইবার আগেই কেন্দ্রীয় সরকার সক্রিয় হইয়াছে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রী দিনভর বৈঠক করিয়া দ্বিমুখী রণকৌশল স্থির করিয়াছেন। প্রথম, অধিকতর মুনাফার প্রত্যাশায় কেহ যদি খাদ্যপণ্য মজুত করেন, তবে তাহা জামিন-অযোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হইবে। দ্বিতীয়, কেন্দ্রীয় সরকার একটি ‘প্রাইস স্টেবিলাইজেশন ফান্ড’ (বা পিএসএফ) গড়িয়া দিবে। যে রাজ্য সরকার মানুষকে স্বল্প মূল্যে পেঁয়াজ ও ফল (হতদরিদ্ররাও তবে ফল খান!) বিক্রয় করিতে চাহিবে, কেন্দ্রীয় সরকার এই তহবিল হইতে সেই রাজ্যগুলিকে ভর্তুকি দিবে। নেহরু-যুগের ভূত যে নেতাদের ছাড়ে নাই, প্রথম সিদ্ধান্তে স্পষ্ট। তবে তাঁহারা স্মরণে রাখিতে পারেন, কালোবাজারিদের ল্যাম্পপোস্টে ঝুলাইবার প্রতিশ্রুতিতে মানুষের মন গলিবার দিন বহু কাল আগেই ফুরাইয়াছে। অর্থনীতিতে তো বটেই, ভোটের ময়দানেও এই হুঙ্কারে আর লাভ হওয়ার নহে।
রাজ্য সরকারকে ভর্তুকি দিয়া পেঁয়াজ ও ফলের দাম কমাইয়া রাখিবার চেষ্টা বিপজ্জনকতর। প্রথমত, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিকে সত্য মানিলে এই সরকার দার্শনিক ভাবে ভর্তুকি-বিরোধী। কিন্তু সে কথা ভুলিয়া গেলেও, এই ভর্তুকিতে লাভ কী? পাইকারি মূল্যসূচকে ইহার প্রভাব পড়া কঠিন, কারণ ভর্তুকি খুচরা বাজারের জন্য। ভারতে যেখানে কৃষিপণ্যের বাজারে সংস্কার প্রয়োজন, সেখানে আরও এক দফা ভর্তুকির ব্যবস্থা করিয়া বিপরীতবিহারের কোনও অর্থ হয় কি? সত্য, আপাতত বাজারে আগুন লাগিয়াছে, ফলে বিভিন্ন স্বল্পকালীন হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হইতে পারে। কিন্তু পিএসএফ তাহার পন্থা নহে। ভারতের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসু একটি টুইট করিয়াছেন: ‘খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য মজুতদারদের দায়ী করা আর বাড়ি ধসিয়া পড়িলে সেই দোষ মাধ্যাকর্ষণের ঘাড়ে চাপাইয়া দেওয়া একই গোত্রের। কথাগুলি ভুল নহে, কিন্তু তাহা জানিয়া কী লাভ?’ বস্তুত, এখন মজুতদারদের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িলে অন্য বিপদের সম্ভাবনা আছে। স্বল্পমেয়াদে হয়তো পেঁয়াজের দাম কমিবে, কিন্তু এক মাসের মধ্যেই দাম আকাশ ছুঁইতে পারে। বিশেষত এই বত্সর বর্ষা মন্দ হইতেছে, ফলে নূতন পেঁয়াজের উত্পাদনের পরিমাণ এখনও অনিশ্চিত। মজুতদারি সমস্যা নহে, তাহা উপসর্গমাত্র। মজুতদারির এই রমরমার কারণ কৃষিপণ্যের অচল বাজার। সেই বাজারের সংস্কার না করিলে কোনও পন্থাতেই মূল্যবৃদ্ধির এই বাত্সরিক কুনাট্য বন্ধ হইবার নহে।
এখনই কৃষিপণ্যের বাজার সম্পূর্ণ খুলিয়া দিলে হয়তো বিপরীত ফল হইতে পারে। কাজটি ধাপে ধাপে করাই বিধেয়। কিন্তু এপিএমসি আইন নামক অযৌক্তিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটি বিদায় করা প্রয়োজন। কৃষিপণ্যের বাজারে কী পদ্ধতিতে সংস্কার করিতে হইবে, তাহার একটি স্পষ্ট রূপরেখা গত বত্সর হর্ষবর্ধন পাটিল কমিটি পেশ করিয়াছিল। ইউপিএ জমানার রিপোর্ট বলিয়া তাহাকে বাতিল কাগজের ঝুড়িতে ফেলিয়া দেওয়ার পূর্বে সুপারিশগুলি নূতন সরকার বিবেচনা করিয়া দেখুক, অমূল্য না হোক, মূল্যবান রত্ন মিলিতে পারে। কৃষিপণ্যের বাজারের সংস্কার, আন্তঃরাজ্য বাণিজ্যে অযৌক্তিক বাধা অপসারণ, লাইসেন্স রাজের অবসান, পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে কৃষিপণ্য বিক্রয় করিবার অধিকার কৃষকদের অর্পণ, চুক্তিচাষের বিকল্প পথ সদুপায় বিস্তর। সরকার সংস্কারে মন দিক, ভর্তুকির পথে মধ্যবিত্ত তোষণে নহে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy