দিল্লিতে রাজ্য সরকার গঠন লইয়া যাহা চলিতেছে, তাহা একটি গর্হিত তামাশা। আম আদমি পার্টির ধূমকেতুসদৃশ আবির্ভাব এবং প্রায় তৎক্ষণাৎ করুণ পলায়নের পরে আট মাস কাটিয়া গিয়াছে, দিল্লিতে সরকার নাই, ত্রিশঙ্কু বিধানসভা থাকিয়াও নাই। ‘অন্য ধরনের’ রাজনীতির সওয়ার হইয়া রাজনীতির মঞ্চে সফল হইয়াছিলেন অরবিন্দ কেজরীবাল, অন্য ধরনের প্রশাসনের নজির গড়িবার সুবর্ণসুযোগ মিলিয়াছিল তাঁহার ও তাঁহার সহকর্মীদের। পরশপাথর ছুড়িয়া ফেলিয়া তাঁহারা নিজেদের ক্ষতি করিয়াছেন, জনাদেশের অমর্যাদা করিয়াছেন এবং গণতন্ত্রের এক অনন্য সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনাশ করিয়াছেন। কিন্তু ভারতীয় জনতা পার্টিও রাজধানীর রাজনীতিতে গৌরবের দাবিদার হইতে পারে নাই। সরকার গঠনের প্রশ্নে তাহারা কেবল অব্যবস্থিতচিত্ততার নজির সৃষ্টি করে নাই, অনৈতিক নেপথ্যলীলার সংশয়ও সৃষ্টি করিয়াছে। আদালতের তিরস্কারের পরে দিল্লির লেফটেনান্ট গভর্নর সর্বদলীয় বৈঠক ডাকিয়াছেন, কিন্তু সেই বৈঠকে কাজের কাজ হইবে, এমন ভরসা যৎসামান্য। এত দিন ধরিয়া কেন দিল্লির নাগরিকরা গণতান্ত্রিক সরকার হইতে বঞ্চিত থাকিবেন, সর্বোচ্চ আদালতের এই প্রশ্ন অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। আইনত কত দিন রাষ্ট্রপতির শাসন চলিতে পারে, তাহা নিতান্তই আইনের প্রশ্ন। আদালত গণতান্ত্রিক নৈতিকতার প্রশ্ন তুলিয়াছে। নৈতিকতাকে আইনের সীমায় বাঁধা চলে না।
আদালতের প্রশ্নটির পিছনে রহিয়াছে গভীরতর নৈতিকতার সমস্যা। নাগরিকরা ভোট দিয়া জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচন করিয়াছেন, তাঁহারা একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার পাইবেন— ইহাই গণতন্ত্রের মৌলিক অনুজ্ঞা। বিধানসভায় আসন ভাগাভাগির কী হাল দাঁড়াইল, তাহাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অঙ্ক কোথায় মেলানো গেল না, কে কাহার সহিত হাত মিলাইতে নারাজ হইলেন, এ সকলই খুঁটিনাটির ব্যাপার, তাহার জন্য গণতান্ত্রিক সরকার মিলিবে না কেন? স্পষ্টতই, সরকার গঠন ও চালনার প্রচলিত নিয়মেই ঘাটতি রহিয়াছে, যাহাকে বলে বিসমিল্লায় গলদ। বিসদৃশ অচলাবস্থাটি রোগের লক্ষণমাত্র। লক্ষণের নহে, ব্যাধির চিকিৎসা প্রয়োজন। প্রয়োজন এমন নিয়মের, যাহাতে সরকার গঠন বাধ্যতামূলক হয়। তাহা কী ভাবে সম্ভব?
সহজ উপায়: সরকার গড়িবার শর্ত এবং পদ্ধতি আইন করিয়া নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া, যাহাতে সেই প্রক্রিয়া কাহারও বিবেচনা বা অভিরুচির উপর বিন্দুমাত্র নির্ভর না করে, যাহাতে নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশিত হইবার পরে বাকি কাজ সম্পূর্ণত অঙ্কের নিয়মে সম্পন্ন হইতে পারে। নিয়মটিও অতি সরল এবং স্পষ্ট। যে দল বা (প্রাক্নির্বাচনী) জোট নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন অর্জন করিবে, তাহাকেই সরকার গঠন করিতে হইবে, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিরঙ্কুশ হোক বা না হোক। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে: সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিরঙ্কুশ না হইলে সরকারের স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা কোথায়? সে জন্য একটি দ্বিতীয় নিয়ম জরুরি। যদি বিরোধীরা সংখ্যালঘু সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাশ করাইতে পারে, তবে তাহাদের একই সঙ্গে একটি বিকল্প সরকার তৈয়ারি করিতে হইবে। জার্মানির মতো দেশে এমন নিয়ম দিব্য কাজ করিতেছে। স্পষ্টতই, এই দুইটি নিয়মের পিছনে একটি প্রাথমিক নীতি কার্যকর: নির্বাচনী রাজনীতিতে যোগ দিলে সরকার গড়িবার দায়িত্ব এড়ানো চলে না। যদি কোনও দল বা জোট এই নীতি অমান্য করে, তবে তাহার নির্বাচনে লড়িবার অধিকার অন্তত নির্ধারিত সময়ের জন্য কাড়িয়া লওয়া জরুরি, সে জন্য জনপ্রতিনিধিত্ব আইন সংশোধন করা দরকার। ইহা কঠোর ব্যবস্থা। এমন ব্যবস্থা না করিতে হইলেই ভাল হইত। কিন্তু ভারতীয় রাজনৈতিক দল এবং তাহার নেতানেত্রীদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতাই এই ধরনের কঠোর আইনি বন্দোবস্তকে কার্যত অপরিহার্য করিয়া তুলিতেছে। যে দেশে যে আচার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy