বিজয়ী। পুনর্নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ও জোটসঙ্গী লালুপ্রসাদ, ১৪ নভেম্বর, পটনা। পিটিআই
লা ড্ডু আর বাজি দিয়ে যখন বিহারে জেডি(ইউ)-আরজেডি-কংগ্রেস মহাজোট তাদের বিরাট জয়ের উৎসব করতে শুরু করেছে, চার দিকে তখনও এই জয়ের পিছনে সম্ভাব্য কারণ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা প্রবল বাদানুবাদে ব্যস্ত। কারও মতের সঙ্গে কারও মত মিলছে না। বাদানুবাদ না মেটার প্রথম কারণ, আমার মতে, এ বারের বিহার নির্বাচনের ‘জাতপাত এবং একটা অন্য কিছু’-র বাস্তবতা। এই ‘অন্য কিছু’টা যে কী, তা-ই নিয়েই গোলমাল। জাতপাতের রাজনীতিতে বাঁধা বিহার সকলের বেশ পরিচিত ছিল। কিন্তু এ বার ভোটে সেটা ছাড়াও ছিল আরও কিছু। সেটা কী? নীতীশ কুমারের উন্নয়ন কর্মসূচিই নিশ্চয়ই বিহারের ছবিটা পাল্টে দিয়েছে!
অন্য একটা ব্যাপারও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ বার মহাজোটের পক্ষে গিয়েছে নীতীশের ‘ব্র্যান্ড ইমেজ’। নীতীশের নামটি এখন উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সমার্থক। চার দিকে সেই উন্নয়নপুরুষের প্রবল উপস্থিতির ছবি গোটা বিহার জুড়ে। নীতীশের এই ইমেজ কিন্তু কেবল সমাজের একটি সীমিত শ্রেণির মধ্যেই আটকে নেই, চুঁইয়ে চুঁইয়ে তা বহুদূর নেমেছে। আর তাই যে সব ‘সবর্ণ’ অর্থাৎ উচ্চজাত-অধ্যুষিত অঞ্চলে বিজেপি তথা এনডিএ-র প্রতিপত্তি থাকার কথা, সেখানেও নীতীশের দল মহানন্দে জয়ের পতাকা উড়াতে পেরেছে। এটা খুবই গুরুতর ব্যাপার। নীতীশের উন্নয়নপুরুষ ইমেজ সব রকম জাতপাত-শ্রেণিবিভেদ বেশ সহজে অতিক্রম করতে পেরেছে। এমন একটা প্রত্যাশা ভোটের আগে থেকেই ছিল। কিন্তু তার শক্তি যে কতটা, সেটা ভোটের আগে বোঝা যায়নি।
তিন নম্বর, জাতপাতভিত্তিক জোটের মধ্যে যে ভাবে দল উপদল তৈরি করা হয়েছে, তার একটা বিরাট সুফল কুড়িয়েছে লালু-নীতীশ অক্ষ। মোট জনসংখ্যার একান্ন শতাংশ অন্যান্য পশ্চাৎপদ শ্রেণি বা ওবিসি, তার মধ্যে যাদব আর কুমারদের বাদ দিয়ে ২৪ শতাংশ অত্যন্ত পশ্চাৎপদ শ্রেণি বা ইবিসি-র অন্তর্ভুক্তি এই মহাজোটকে নিশ্চিত ভাবে সংখ্যার দিক থেকে এগিয়ে রেখেছিল। এই ইবিসি-র (যাদের পাঁচপানিয়া বা পাঁচপবনীজন বলা হয়) ভূমিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সেটা আগে থেকেই বলে আসছিলেন। ইবিসি ভোট নীতীশ-লালুর মহাগঠবন্ধনের দিকে আসবে, সেটা ধরে রাখা হচ্ছিল। নীতীশই এই জাত-দলটি তৈরির কারিগর, তাঁর হাত দিয়েই ১৭ শতাংশ সংরক্ষণ এদের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, এদের স্পষ্ট একটা রাজনৈতিক উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছে। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের মন্তব্য ইবিসি ভোটারদের নজর এড়ায়নি: বিজেপি জিতলে এই ইবিসি সংরক্ষণের ব্যাপারটা নতুন করে খতিয়ে দেখা হবে, বলেছিলেন তিনি। তাঁর এই একটি অবস্থানেই এনডিএ-র কপাল অনেকটা পুড়েছে। এ দিকে, ভোটের প্রচার শুরু হওয়ার আগে থেকেই এই একটা জায়গায় লালু বা নীতীশ কোনও ভুল করেননি। সামাজিক ন্যায়ের নাম করে এই জাতগোষ্ঠীকে সমানে তাদের ভাগ ও ভূমিকা নিয়ে আশ্বস্ত করে গিয়েছেন।
চার, লালু ও নীতীশের সন্ধি কতটা সুযোগসন্ধানী, কতটা নড়বড়ে, এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু সম্ভবত ভোটাররা এর মধ্যে নেতিবাচক দিকের বদলে ইতিবাচক দিকটাই বেশি করে খুঁজে পেয়েছেন। অনেক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও যে তাঁরা দু’জন হাত মেলাতে পেরেছেন, ঠিক সময়ে সেটা করতে পেরেছেন— কম কথা নয়। এইটুকুই তাঁদের জয়ের পথে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে।
পাঁচ নম্বরে রাখতে হবে গরু এবং গোমাংসকে! এই বিষয়টি পুরোপুরি এনডিএ-র বিপক্ষে গিয়েছে। গেরুয়া-বাহিনীর নেতারা যতই বলুন না কেন যে ৫২ বছর বয়সি আখলাকের গণনিধন একটা ‘বিক্ষিপ্ত ঘটনা’, ব্যাপারটা তাঁদের মোটেই সাহায্য করেনি। মুসলিমরা তো এতে মর্মান্তিক খেপেছেন বটেই, অ-মুসলমানরাও আশ্বস্ত বোধ করেননি। এনডিএ না পেরেছে হিন্দু ভোটারদের যথেষ্ট তুষ্ট করতে, না পেরেছে স্ট্র্যাটেজিক ভাবেও মুসলিম দলিত ভোটারদের দলে টানতে। দুই দিক দিয়েই যাঁরা লাভবান হয়েছেন, তাঁদের নাম লালুপ্রসাদ ও নীতীশ কুমার।
ছয়, কোন আসনে কোন দলের প্রার্থী দাঁড়াবেন, এই বিবেচনার দিক থেকে বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছে নীতীশ-লালুর মহাজোট। কেবল স্থানীয় সামাজিক হিসেব কষেই এই জোটের প্রার্থীদের মধ্যে আসন বিতরিত হয়নি। আরও একটা দিকে লক্ষ্য রাখা হয়েছে: কোন প্রার্থীর ইমেজ কেমন। ক্রমশ এ বিষয়টি ভোটারদের চোখে গুরুতর হয়ে উঠছে, এ বারের বিহার নির্বাচনই তা বলে দেয়।
জাতভিত্তিক সংরক্ষণ থেকে যে ভারতীয় সমাজকে সহজে নড়ানো যাবে না, সেটাও এ বারের বিহার ভোটের পরিষ্কার বার্তা। যেহেতু এনডিএ একাধিক বার সংরক্ষণ নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, বিহারের যুবশক্তি কোন দিকে যাবে, সেটা মোটামুটি তখনই ঠিক হয়ে গিয়েছে। দূরদূরান্তরের গ্রামেগঞ্জে এনডিএ-বিরোধী প্রচারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছে সংরক্ষণপন্থী যুব ক্যাম্পেন। তার কাজই ছিল, নীতীশ-লালুর সপক্ষে সমর্থন নিশ্চিত করা।
‘রেটরিক’ বা ভোট-ভাষার ভূমিকাকেও ছোট করে দেখা যাবে না। ২৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী মোদী বিরাট ভুল করে ফেললেন নীতীশ কুমার বিষয়ে একটি মন্তব্য করে: ‘ইস আদমি কা ডিএনএ হি খরাব হৈ।’ নীতীশ সময় নষ্ট করেননি। একে একে লালু, সনিয়া গাঁধী, এবং মুলায়ম সিংহ যাদব, সকলকে দিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য বিষয়ে প্রতি-মন্তব্য ও সমালোচনা করিয়ে নিয়েছেন, বিহারবাসীকে বুঝিয়েছেন যে তাঁর ডিএনএ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে মোদী আসলে সমস্ত বিহারবাসীর ডিএনএ-রই অসম্মান করেছেন। শেষ পর্যন্ত গোটা ঘটনায় নীতীশের সমস্যা তো হয়ইনি, বরং মুখোজ্জ্বল হয়েছে। ‘স্বাভিমান মিছিল’-এর আয়োজন এ ক্ষেত্রে বিরাট ভাবে ফলপ্রসূ হয়েছে।
একটা বিষয় আলাদা করে উল্লেখের দাবি রাখে। সেটা বিশাল সংখ্যায় মহিলা ভোটারদের অংশগ্রহণ। নীতীশ সরকারের কন্যামুখী সরকারি প্রকল্পগুলি কতটা সফল, এই ছবিটা থেকেই স্পষ্ট। রাজ্যের একেবারে প্রত্যন্ততম অঞ্চলগুলিতেও পৌঁছে দিয়েছে প্রকল্পগুলির সুফল, তার পরবর্তী ফলও ফলতে শুরু করেছে। পরবর্তী ফলের মধ্যে নীতীশের প্রতি মহিলাদের অকুণ্ঠ সমর্থনও পড়ে বই কী। মহিলারা তাঁদের মেয়েদের শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পেতে দেখছেন, মেয়েদের জন্য তাঁরা একটা অন্য রকম ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছেন। নীতীশের মহাজোটের প্রতি সমর্থনে সেই স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি।
সব মিলিয়েই মহাজোটের এই সুবিশাল জয়। অবশ্যই এই জয়ের প্রভাব বিহার ছাড়িয়ে আরও বহু দূর যাবে। মোদীর অবস্থান দুর্বল হয়ে গোটা দেশেই বিজেপির মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংকট ক্রমশ বাড়বে, এমন সন্দেহ করার যথেষ্ট ভিত্তি আছে। এমনকী দলের মধ্যে একটা জোরদার মোদী-বিরোধী লবিও তৈরি হয়ে যেতে পারে। বিজেপি সরকার সংসদে নিজেদের পক্ষে যথেষ্ট সংখ্যার অভাবে কোনও বিলই সুষ্ঠু ভাবে পাশ করাতে পারবে না। এর ফলেও বিজেপির ভেতরে অশান্তি ও সংঘর্ষ বাড়ার সম্ভাবনা। সব মিলিয়ে বিহার মোদীকে শক্ত জায়গায় ঠেলে দিয়েছে বলেই মনে হয়। বিজেপি-কেও।
ইলাহাবাদে জি বি পন্থ সোশ্যাল সায়েন্স ইনস্টিটিউটে সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy