Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

ভগবানের সাচ্চা বাচ্চা

হেব্বি লাগে! কেমন কুপিয়ে মারলাম! লোকটা স্ট্রেট মরে গেল। অত ইন্টেলেকচুয়াল ফটরফটর বাগিয়ে কী লাভ হল? আরে, যদ্দিন বাঁচবি, বউ-বাচ্চা নিয়ে পৃথিবীকে মেখেচেখে ভোগ কর, মেলায় নাগরদোলা চড়, কে বারণ করেছে। এখন কী কেলো, প্রাণটাই চলে গেল, বউয়েরও কয়েকটা আঙুল বাদ পড়ে গেল, তোর ব্লগ এখন কে লিখবে? বারবার সাবধান করেছিলুম, কিছুতে শুনলি নে।

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

হেব্বি লাগে! কেমন কুপিয়ে মারলাম! লোকটা স্ট্রেট মরে গেল। অত ইন্টেলেকচুয়াল ফটরফটর বাগিয়ে কী লাভ হল? আরে, যদ্দিন বাঁচবি, বউ-বাচ্চা নিয়ে পৃথিবীকে মেখেচেখে ভোগ কর, মেলায় নাগরদোলা চড়, কে বারণ করেছে। এখন কী কেলো, প্রাণটাই চলে গেল, বউয়েরও কয়েকটা আঙুল বাদ পড়ে গেল, তোর ব্লগ এখন কে লিখবে? বারবার সাবধান করেছিলুম, কিছুতে শুনলি নে। এ বার? অস্তিত্বটার আর কোনও চিহ্নও নেই। হ্যাঁ, সভাফভা হবে, ‘ওগো শহিদ’ কান্নার ফ্লাড ওথলাবে, চাট্টি রবীন্দ্রসংগীতও, কিন্তু তাতে তোর কী আসবে-যাবে? তোর তো চুকে গেল।

অবান্তর কাজেই লোক কুমির ডেকে আনে। মুক্তমনা হওয়ার দরকারটা কী? মুক্তমনা মানেই বা কী? কেউ সত্যি মুক্তমনা হতে পারে? যে লোকটা সাম্প্রদায়িকতা মানে না, সে-ও সমকামের ব্যাপারটায় হোঁচট খায়। যে বিবাহ প্রতিষ্ঠানকে তুলোধোনা করে, সে-ও এক বিছানায় তিন জনকে দেখলে বোমকে বিয়াল্লিশ। গোটা মহাবিশ্বকে আকচে নেওয়ার মেগা-কোলাকুলির খ্যামতা ক’জনের?

আরও গ্যাঁড়াকল আছে। থিয়োরি চর্চার সময় সর্বদা মনে রাখতে হয়, যে কোনও যুক্তির মোক্ষম প্রতিযুক্তি থাকতেই পারে, অতএব, নিজের সব তত্ত্ব, সব অনুমান নিমেষে ভুল প্রমাণিত হয়ে যেতে পারে। যথার্থ মুক্তমনা হলে, এমন একখান সম্ভাব্য পাহারোলা মনে খাড়া রেখেই কথাবাত্তা বলতে হয়। ‘আমার আপাতত এটাই ঠিক মনে হচ্ছে। যদি কেউ দুর্দান্ত লজিক সহ অন্য সাইড দেখাতে পারে, নির্ঘাত মেনে নেব’ এই আলোচনাবান্ধব পোজে ছক্কা চালতে হয়। সোজা কথায়, প্রফেশনাল কনফিউজ্ড হতে হয়। তা হলে, আল্টিমেটলি, থিয়োরি কপচাবারই আদৌ দরকার কী?

এই ফিল্ডে আমাদের অসম্ভব সুবিধে। আমরা এক সেকেন্ডের জন্যও ভাবি না, আমাদের ভাবনা এক কণাও ভুল হতে পারে। কী করে হবে? আমাদের হাতে যে চাকু! যার আওতায় পেটানির ডান্ডা, আর একখান চিক্কুর পাড়লেই ডান্ডা হাতে ছুটে আসার খানতিনশো লোক, তার ফিলজফি কখনও খুঁতো হয়? আর, ভাবনা ভুল হবেই বা কী করে? আমি তো কখনও কিছু ভাবিই না। আমি তো কিচ্ছু পড়িনি, শুনিনি, জানিনি। ভাবতে বসে তো তারা, যারা নিশ্চিত নয়। যারা ভগবানের সাচ্চা বাচ্চা, যাদের মনে গাবদা ভাল্লুকের মতো বিশ্বাস উবু, তাদের কাজ শুধু লাল লাল চোখ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো আর বেগড়বাই বুঝলেই থাবড়া তোলা। আমি শুধু রোজ সকালে উঠে ঠিক করি, আজ কাকে পেটাব। মানুষকে গুছিয়ে পেটাবার যে আরাম রে ভাই, ওঃ, সব অর্গ্যাজ্ম, সব ইউফোরিয়ার বাবা! নাড়িভুঁড়ি ফেঁসে যখন রক্ত গলগলিয়ে ওগলায় না, বিউটি! মজা দেড়া হয়ে মৌতাত কীসে জমে বল দিকিনি? যখন বুঝি, আমাকে কেউ ফিরে মারতে পারবে না।

মারবে কোত্থেকে? আমি তো আমার মতো অন্য গুন্ডাকে পেটাতে যাচ্ছি না! ও বাবা, সে দিকে বহুত স্যায়না আমি। কক্ষনও আর্মড লোকের পেছনে লাগি না। আমি শুধু তাদের সঙ্গে রোয়াব মারি, যে লোকটা লেখালিখিতে বাঘ, কিন্তু হাঁটাহাঁটির টাইমে একলা। তার ট্যাঁকে বন্দুক নেই, চারপাশে লাল-আলো জ্বলা ইস্পাতের গাড়ি নেই, বামচাক বডিগার্ড নেই। তার চিমড়ে পকেটে ওই লিকলিকে পেন আমাদের কী করবে? অসির চেয়ে মসী ধারালো ওটা প্রিন্টিং মিসটেক, বাওয়া। নইলে তো রাজা-রাজড়ারা ইয়া ইয়া কলম বাগিয়ে ঘোড়ায় চড়ে হারেরে ধেয়ে যেত! মসীর গ্লোরি তো বোঝাই গেল, যখন ভারতের মুরুগান নামে লেখকটা অপমানের ঝাপড়া খেয়ে নিজের ওবিচুয়ারি লিখে বসল!

সেই সিনে আমি অবশ্য অন্য ধর্মের ইজারা নিয়ে টকাস টকাস তুড়ি বাজাচ্ছিলাম। তাতে কী? ধর্মটা আমাদের কাছে ইম্পর্ট্যান্টই নয়, আসলি হল মার-টা। মুরুগান নিজেই ফেসবুকে লিখল, তার লেখক-সত্তার মৃত্যু হয়েছে, তার বইগুলো যেন প্রকাশকরা আর বিক্কিরি না করে, পাঠকরা যেন তার বই পুড়িয়ে ফেলে। প্রতীকী সুইসাইড না করে ব্যাটা যাবে কোথায়? আমরা ওর নভেলের বিরুদ্ধে রাস্তায় শয়ে শয়ে লোক নামিয়ে দিয়েছিলাম। হয়তো ওকেও কুপিয়ে মারতাম, তার আগে নিজেই মোলো! মর! আরও মর! লেখকগুলো কবিগুলো ঝাড়েবংশে মর! সব স্বাধীন চিন্তক, বেপরোয়া ভাবুক, নাছোড় থটবাজ মরে খাক হ!

অ্যায়, ঠিক ধরেছ, আমাদের আসলি অ্যালার্জি স্বাধীনতায়। ভগবান আল্লা গড নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। মৌলবাদী বললেই স্ক্রিনে ধর্মান্ধ পাবলিক ভেসে ওঠে তো? টোটাল মিসটেক! মৌলবাদী সে, যার বুকের ভেতর বহুত খার লকলকাচ্ছে। সারা দিন এই ঝাঁঝালো বিষ লোপালুপি করে সে কার ঘাড়ে ঝাড়বে? বউ? ভাইপো? মুদি? ওরে, তাতেও অনেক বাড়তি থাকে। তখন দুপুরটায় মনে হয় সিনেমা হল ভেঙে আসি, সন্ধেয় ভাবি কয়েকটা খুলি দুমড়ে এলে কেমন হত, রাত্তিরে বস্তি জ্বালাবার জন্য মশাল নিশপিশ করে। অশান্তি, আরও অশান্তি বাধিয়ে দিতে ভেতরটা সুলসুলোয়। সবচেয়ে রাগ চড়ে যায় তাদের দেখে, যারা শেখানো বুলি না কপচে, চলতি মতে গৎ না মিলিয়ে, নিজের মতো বাক্যি আওড়ায়। আরে, আমরা সব্বাই ঠেসাঠেসি মেরে এক কাদায় নাক গুঁজড়ে আছি, এক বাগে থুতু ছুড়ছি, তুমি কোথাকার হনু, নিজ ভাবনার ডানায় উড়াল নিচ্ছ, দড়িদড়াহীন? সব আপ্তবাক্যকে ওজনদাঁড়িতে চাপাবার আস্পদ্দা তোমায় হয় কোত্থেকে? মানুষ হচ্ছে পরিবারের অধীন, সমাজের অধীন, নেতার, টিভির, প্রথার, ঈশ্বরের অধীন। তাই মেনে আমরা অলটাইম হাতজোড় পোজে নতমাথায় শেকল-ঝনঝনের তালে ঘাস-বিচুলি করছি, আর তুমি রেলার চোটে মাথা তুলে মিটিমিটি হাসছ? উঁচু মাথা দেখলে হেভি অবাক লাগে, হিংসেও হয়। নিজের ব্যাঁকা মেরুদাঁড়া এক্সট্রা ছ্যাঁকা মারে। অ্যাত্ত জ্বলুনির মোকাবিলা কী দিয়ে করব, ধারালো ছুরি ছাড়া?

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE