Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

ভেজাল হইতে সাবধান

একা সাহিত্যে রক্ষা নাই, অর্থনীতি সহায়। পাত্রিক মদিয়ানোর পরে জঁ তিরোল নোবেল পুরস্কার জয় করিবার ফলে ফরাসি জাতীয়তাবাদ সহসা উচ্ছ্বসিত। দোষ দেওয়া চলে না, বিশেষত হৃতগৌরব ইউরোপ এবং ইউরোপের মধ্যেও বিষাদগ্রস্ত ফ্রান্স এমন অবস্থায় নেপোলিয়নের উত্তরসূরিরা সুইডেন হইতে ভাসিয়া আসা সুসংবাদযুগলকে খড়কুটোর মতো আঁকড়াইয়া ধরিবেন, স্বাভাবিক।

শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

একা সাহিত্যে রক্ষা নাই, অর্থনীতি সহায়। পাত্রিক মদিয়ানোর পরে জঁ তিরোল নোবেল পুরস্কার জয় করিবার ফলে ফরাসি জাতীয়তাবাদ সহসা উচ্ছ্বসিত। দোষ দেওয়া চলে না, বিশেষত হৃতগৌরব ইউরোপ এবং ইউরোপের মধ্যেও বিষাদগ্রস্ত ফ্রান্স এমন অবস্থায় নেপোলিয়নের উত্তরসূরিরা সুইডেন হইতে ভাসিয়া আসা সুসংবাদযুগলকে খড়কুটোর মতো আঁকড়াইয়া ধরিবেন, স্বাভাবিক। আবার, অ্যাংলো-স্যাক্সন দুনিয়া হইতে সেই জাতীয়তাবাদী অভিমানের রকমারি অম্লমধুর জবাব নিক্ষিপ্ত হইবে, ‘দুইখান নোবেল পুরস্কার দিয়া ফ্রান্সের দুরবস্থা ঢাকা যায় না’ গোছের বক্রোক্তি অতলান্তিক ও ইংলিশ চ্যানেল পার হইয়া আছড়াইয়া পড়িবে, তাহাও ইতিহাসের দুর্মর পরিণাম। কিন্তু এই সওয়াল-জবাবে একটি দুর্ভাগ্যজনক চিন্তা-বিভ্রাট ঘটিয়া যাইতেছে। ফরাসি অর্থনীতিবিদ জঁ তিরোল-এর নোবেল জয়ের সহিত তাঁহার দেশের তথা মহাদেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার ‘তুলনা’ করিয়া সমালোচকরা বলিতেছেন, এই খেতাব ব্যক্তির, তাহা ফরাসি বা ইউরোাপীয় অর্থনীতি-চিন্তার উত্‌কর্ষ প্রমাণ করে না, করিলে তাহাদের অর্থনীতির এমন করুণ দশা কেন? এই সমালোচনাকে নিছক ছিদ্রান্বেষণ বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া চলিত, যদি না ইহার গভীরে নিহিত থাকিত অর্থনীতি সম্পর্কে এক মৌলিক ভ্রান্তি। নোবেল পুরস্কার সম্পর্কিত আলোচনা বারংবার সেই ভ্রান্তিকে চিনাইয়া দেয়। ২০১৪ সালও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই।

জঁ তিরোল অর্থনীতির উত্‌কৃষ্ট তাত্ত্বিক। শিল্পসংস্থার সাংগঠনিক কাঠামো সম্পর্কে তাঁহার বিশ্লেষণ এই বিষয়টিকে যথার্থ তাত্ত্বিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করিতে সাহায্য করিয়াছে, বস্তুত ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশন’ বিদ্যাটিকে ম্যানেজমেন্ট-এর ফলিত চর্চা হইতে অর্থনীতির যথার্থ তত্ত্বলোকে উত্তীর্ণ হইতে বিশেষ ভাবে সাহায্য করিয়াছে। বাজারে যথেষ্ট প্রতিযোগী না থাকিলে বাজারের কাঠামোয় কী ধরনের সমস্যা দেখা দেয় এবং তাহার মোকাবিলায় কী ভাবে বাহিরের নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক হয়, সেই বিষয়েও তিরোল-এর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ মূল্যবান। উচ্চাঙ্গের গণিতনির্ভর, বিশেষত গেম থিয়োরি-সমৃদ্ধ এই গবেষণা আধুনিক অর্থনীতির তাত্ত্বিক কাঠামোয় গভীর ভাবে প্রোথিত। বাস্তব দুনিয়ায় সেই তত্ত্বের প্রয়োগ হইতে পারে, হইয়াছে, তাহার ফলে বাজার বা শিল্পসংস্থার পরিচালনা হয়তো উন্নততর হইয়াছে, কিন্তু সেই প্রয়োগের উপর তত্ত্বের উত্‌কর্ষ নির্ভর করে না, তাহার মূল্য বিশুদ্ধ বিশ্লেষণের দেবলোকে। দেবতার আশীর্বাদ ধূলিমলিন মর্তের উপকারে লাগিল কি না, তাহা মর্ত্যবাসীর বিবেচ্য, দেবতাদের নয়।

পদার্থবিদ্যা বা রসায়ন কিংবা বিশুদ্ধ গণিতের ক্ষেত্রে এই সত্য স্বভাবত স্বীকৃত। এই সকল বিষয়ে নোবেল পুরস্কার (বা ফিল্ডস মেড্ল) প্রাপকদের গবেষণায় বাস্তব পৃথিবীর কী ক্ষতিবৃদ্ধি হইল, তাহা অন্তত পুরস্কারের গুরুত্ব নির্ধারণে বিচার্য হইয়া ওঠে না। কিন্তু অর্থনীতির তাত্ত্বিক উত্‌কর্ষে বিচারক, অনুরাগী, সমালোচক, কাহারও যেন মন ওঠে না, সেই তত্ত্বের ব্যবহারিক উপযোগিতা লইয়া সকলে ব্যস্ত হইয়া পড়েন। অমর্ত্য সেন সোশাল চয়েস থিয়োরির দুরূহ জটিল তত্ত্বের গবেষণা করিয়া নোবেল পুরস্কার পান, কিন্তু তাঁহার নাম বিশ্বে বন্দিত হয় ‘অর্থনীতির বিবেক’ হিসাবে আক্ষেপের কথা, এই অভিধাটি তাঁহাকে যিনি দিয়াছিলেন সেই রবার্ট সোলো নিজে নোবেলজয়ী অর্থশাস্ত্রী। জঁ তিরোল সম্পর্কেও যে সাত কাহন লেখা হইতেছে, তাহার অন্তত ছয় কাহনই ইউরোপ তথা মর্তভূমির জনজীবনে তাঁহার তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা লইয়া। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের সামাজিক উপকারিতা যাচাইয়ের এই কু-অভ্যাস পীড়াদায়ক। বিশুদ্ধ জ্ঞানের স্বীকৃতিতে মর্তধূলির ভেজাল না মিশাইলেই কি নয়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE