Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

ভুল প্রশ্ন

শহর জুড়িয়া কোন নির্বাচনের প্রচার চলিতেছে, গুলাইয়া যাওয়া স্বাভাবিক। বিদায়ী পুরসভার পাঁচ বৎসরে তাহাদের সকল প্রচারের মুখ থাকিয়াছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরোধী পক্ষের নির্বাচনের প্রচারে, অতএব, তিনিই আক্রমণের লক্ষ্য। অস্বাভাবিক নহে। কালীঘাটে দল ও দলনেত্রী সমার্থক। কিন্তু, তাঁহাকে আক্রমণের যে অস্ত্র বিরোধীরা বাছিয়াছেন, তাহাতেই গোল পাকাইয়াছে। মুখ্যমন্ত্রীর ছবি বিক্রির হিসাব যতই মনোগ্রাহী হউক, কলিকাতা পুরসভার সহিত তাহা সম্পর্কহীন।

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৫
Share: Save:

শহর জুড়িয়া কোন নির্বাচনের প্রচার চলিতেছে, গুলাইয়া যাওয়া স্বাভাবিক। বিদায়ী পুরসভার পাঁচ বৎসরে তাহাদের সকল প্রচারের মুখ থাকিয়াছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরোধী পক্ষের নির্বাচনের প্রচারে, অতএব, তিনিই আক্রমণের লক্ষ্য। অস্বাভাবিক নহে। কালীঘাটে দল ও দলনেত্রী সমার্থক। কিন্তু, তাঁহাকে আক্রমণের যে অস্ত্র বিরোধীরা বাছিয়াছেন, তাহাতেই গোল পাকাইয়াছে। মুখ্যমন্ত্রীর ছবি বিক্রির হিসাব যতই মনোগ্রাহী হউক, কলিকাতা পুরসভার সহিত তাহা সম্পর্কহীন। সেই হিসাবের তদন্ত চলিতেছে। গরমিল পাওয়া গেলে তাহা রাজনৈতিক আক্রমণের অস্ত্রও হইবে বিলক্ষণ। কিন্তু, ক্রিকেট ব্যাট যতই মজবুত হইক, ফুটবল মাঠে সেই ব্যাট হাতে নামা অর্থহীন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি বিক্রয়ের হিসাবে জলের পরিমাণ বারো আনা হইলেও তাহা কলিকাতা পুরসভার নির্বাচনে অপ্রাসঙ্গিক। কারণ সহজ— সেই হিসাব রাখা পুরসভার কর্তব্যতালিকায় ছিল না। পুরসভার কাজ শহরে নাগরিক পরিষেবার ব্যবস্থা করা, পরিকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণ। ছবির হিসাবে মনোনিবেশ করিয়া বিরোধীরা সেই প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ ভুলিয়াছেন। পুরসভা নিজের দায়িত্ব পালনে কতখানি সফল হইল, আর ব্যর্থতাই বা কতখানি, বিরোধীরা সেই দিকে কার্যত তাকাইলেন না। নির্বাচনের মতামত সমীক্ষার ফল বলিতেছে, তাঁহাদের চালটি আত্মঘাতী হইয়াছে।

রাজনীতিকরা ভুলিয়া যান, ভোটদাতাদের নিজস্ব বিবেচনা আছে। কোন নির্বাচনে কী প্রশ্নের উত্তর খুঁজিতে হয়, তাঁহারা বিলক্ষণ জানেন। পুরসভা নীতিনির্ধারক প্রতিষ্ঠান নহে— তাহার কাজ পরিষেবা দেওয়া। প্রাক্‌-নির্বাচনী সমীক্ষায় স্পষ্ট, কলিকাতাবাসী সেই পাখির চোখ দেখিতেছেন। বিপরীতে, বিরোধী দলগুলির প্রচারে বোধ হইতেছে, নাগরিক পরিষেবা তাহাদের নিকট নিতান্তই দ্বিতীয় সারির প্রশ্ন। বৃষ্টি হইলে শহরের রাস্তায় জল জমে কি না, রাস্তার অবস্থা পূর্বের তুলনায় শুধরাইল কি না, ফুটপাথগুলি আর হাঁটিবার উপযুক্ত আছে কি না, জঞ্জাল সাফ হয় কি না, পানীয় জলের গুণগত মান কী রকম, পুরসভার নির্বাচনে মানুষ এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজে। বাম-বিজেপির সম্মিলিত বিরোধী শিবির এই দিকে নজর ফিরাইবার ফুরসত পায় নাই। কেন, কালীঘাটের ঘনিষ্ঠরা তাহার একটি সম্ভাব্য জবাব হাওয়ায় ভাসাইয়া দিতে পারেন। বলিতে পারেন, এই পরিষেবার মান ফিরিয়াছে বলিয়াই আর আক্রমণের উপায় নাই। যুক্তিটি যথার্থ কি না, তাহা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু, সারদা কাণ্ড অথবা খাগড়াগড়, এমনকী শহরের বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে রাজনৈতিক দাপাদাপিও মানুষের পুরভোটের বিবেচ্য তালিকায় ঠাঁই পায় নাই। কলিকাতার সর্বাপেক্ষা বড় সমস্যা কোনটি, সেই প্রশ্নের উত্তরে জল, নিকাশি, জঞ্জাল, সড়কই একচ্ছত্র গুরুত্ব পাইয়াছে। পুরভোটে তেমনটি হওয়াই বিধেয়।

বিরোধীরা লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচনের সহিত পুরসভার ফারাক করিতে পারেন নাই। একই দল যখন বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তখন এই বিভ্রান্তি প্রায় অনিবার্য। সেই কারণেই, সর্বভারতীয় বা রাজ্য স্তরে আর পুরসভায় দল পৃথক হওয়া বিধেয়। প্রথম দুইটি স্তরে অন্যতম প্রধান কাজ নীতিনির্ধারণ। তৃতীয় এবং সর্বনিম্ন স্তরের কাজ পরিষেবা প্রদান। ক্ষেত্র পৃথক হইলে দল এবং তাহার রাজনীতি পৃথক হওয়া জরুরি। যে দল প্রথম দুইটি স্তরে নির্বাচন লড়িবে, সেই দল তৃতীয় স্তরে যোগ দিতে পারিবে না, এমন নিয়ম বাঁধিয়া দেওয়া প্রয়োজন। পুরসভা যদি নির্বাচনের মাধ্যমেই গড়িতে হয়, তবে তাহার জন্য স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল থাকা বিধেয়। নচেৎ, নাগরিক পরিষেবার প্রশ্নগুলি এমন ভাবেই উপেক্ষিত হইবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE