Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

মানবপ্রতিমা

গ ঙ্গা ও যমুনা আর কেবল নদী নহে, আদালতের নির্দেশে তাহারা অতঃপর মানবপ্রতিমা। তাহাদের মানবাধিকার রহিয়াছে— জানাইয়া দিল উত্তরাখণ্ড হাইকোর্ট।

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

গ ঙ্গা ও যমুনা আর কেবল নদী নহে, আদালতের নির্দেশে তাহারা অতঃপর মানবপ্রতিমা। তাহাদের মানবাধিকার রহিয়াছে— জানাইয়া দিল উত্তরাখণ্ড হাইকোর্ট। উচ্চ আদালতের বিধান: সংবিধানে নাগরিকদের নিমিত্ত বরাদ্দ মৌলিক অধিকার নদীরও প্রাপ্য। নদীর মানবাধিকার প্রাপ্তি অবশ্য নূতন নহে। গত সপ্তাহে নিউজিল্যান্ডের পার্লামেন্ট সেই দেশের ওয়াংগানুই নদীকে মানব-সত্তা অর্পণ করিয়াছে। বিস্ময়কর? সত্য, তবে সেই বিস্ময় আধুনিক নাগরিকের। অতীতের মানুষ এই সংবাদগুলিতে কিছুমাত্র বিস্ময় বোধ করিতেন না, বরং ইহা ভাবিয়াই অবাক হইতেন যে, নদীকে আইন-আদালত ঘুরিয়া আপন মর্যাদা অর্জন করিতে হইবে কেন? ভারতে তো বটেই, পৃথিবীর নানা সভ্যতায় প্রাচীন কাল হইতে নদীকে দেবীর আসন দিয়া বন্দনা করিবার প্রচলন ছিল। এখনও নানা দেশে নানা জনজাতি সেই রীতি মানিয়া চলে। তাহাদের বিশ্বাস, এই রীতি সচল থাকিলে মানবসভ্যতাও নদীর মতোই সচল থাকিবে। আদালতের রায় সেই বিশ্বাসকেই সম্মান জানাইল।

কিন্তু সেই বিশ্বাস সমানে চলিতেছে, এমন কথা বলিবার উপায় নাই। মানুষ যত আধুনিক হইয়াছে, প্রকৃতিকে ততই লুণ্ঠনের সামগ্রী বিবেচনা করিয়াছে। অরণ্য ও নদনদী সেই লুণ্ঠনের প্রধান শিকার। শিল্পবিপ্লবের কাল হইতে নদীর উপর যে পরিমাণ অত্যাচার মানবজাতি করিয়াছে, তাহা আক্ষরিক অর্থেই ভীতিপ্রদ। নদীর জল যথেচ্ছ তুলিয়া, অতিকায় বাঁধ নির্মাণে তাহার স্বাভাবিক গতি রোধ করিয়া, বিপুল পরিমাণে জৈব ও রাসায়নিক আবর্জনা নদীতে ফেলিয়া, এমনকী বিদেশি সংস্থাকে নদী বিক্রয় করিয়া অকল্পনীয় অবিবেচনাই যেন আধুনিক নগরসভ্যতার চরিত্রলক্ষণ। এই আচরণের একটি উৎকট দৃষ্টান্ত বারাণসীর গঙ্গা। তাহার পুণ্যসলিলে স্নান করিলে পাপক্ষালন হয় কি না, যোগী আদিত্যনাথ বলিতে পারিবেন, কিন্তু শরীরে রোগ বাসা বাঁধিতে পারে, বুঝিতে কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। বিশ্বেশ্বরের আস্তানাটি এ ঘোর কলিতে যতই মোদীর খাসতালুক হউক, মা গঙ্গার সন্তানকুল দিল্লীশ্বরকে মান্য করিয়া জননীর উপর অত্যাচার কিছুমাত্র কমাইয়াছেন বলিয়া শোনা যায় নাই। আদালতের নির্দেশে তাঁহারা নদীকে সম্মান দিবেন— এমন আশা বোধ করি বাতুলতা।

ভরসা একটিই। স্বার্থবোধের ভরসা। নদীর উপর অত্যাচার চরমে উঠিলে মানুষ নিজে বিপদে পড়িবে, এই বোধটিই হয়তো তাহাকে প্রতিকারের পথ খুঁজিতে বাধ্য করিবে। সেই পথের সন্ধান রহিয়াছে তাহার ইতিহাসেই। যত দিন মানুষ নদীর ‘সম্মতি’ লইয়া তাহার জল ব্যবহার করিয়াছে, অর্থাৎ নদীর পথে বাধা সৃষ্টি করে নাই, নদীকে নর্দমায় পরিণত করে নাই, তত দিন নদীও তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিয়াছে এবং তাহার সভ্যতাকে ধারণ করিয়াছে। সভ্যতা নদীমাতৃক থাকিয়াছে। নদীর যে অধিকারের কথা আজ আইন-আদালত মারফত বুঝিতে হইতেছে, তাহার মূলে ছিল এই সম্মতির ধারণা। ঠেকায় পড়িয়া আজ যদি মানুষ সেই প্রাচীন ধারণাকে নূতন করিয়া আবিষ্কার ও আত্মস্থ করে, ক্ষতি কিছু নাই। সে জন্য নদীকে দেবীর আসনে বসাইবারও কোনও প্রয়োজন নাই, মানুষের মর্যাদা তাহাকে অর্পণ করিলেই চলিবে। মোদী-যোগীরা দেবী গঙ্গার পূজায় প্রাণপাত করিতে পারেন, তাহাতে হয়তো ভোট বাড়িবে, আর কিছু নহে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE