Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

মীমাংসার শর্ত

স হসা ‘মাতৃভূমি’ এবং ‘পিতৃভূমি’ শব্দ দুইটির অর্থের কিঞ্চিৎ মেদবৃদ্ধি ঘটিয়াছে। তাহা আর কেবল ‘জন্মভূমি’-মার্কা একটি ব্যঞ্জনায় আবদ্ধ নহে, বরং ‘নারী-পুরুষ লড়াইয়ের রণভূমি’তে পরিণত। অর্থের এ হেন রূপান্তরে সময় লাগিল মোটে দশ দিন। ইহাতে অবশ্য ভাষাবিদদের উৎসাহিত হইবার কারণ নাই।

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

স হসা ‘মাতৃভূমি’ এবং ‘পিতৃভূমি’ শব্দ দুইটির অর্থের কিঞ্চিৎ মেদবৃদ্ধি ঘটিয়াছে। তাহা আর কেবল ‘জন্মভূমি’-মার্কা একটি ব্যঞ্জনায় আবদ্ধ নহে, বরং ‘নারী-পুরুষ লড়াইয়ের রণভূমি’তে পরিণত। অর্থের এ হেন রূপান্তরে সময় লাগিল মোটে দশ দিন। ইহাতে অবশ্য ভাষাবিদদের উৎসাহিত হইবার কারণ নাই। রূপান্তরের ইতিহাসটি কলঙ্কময়। লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক ভেদাভেদের অভূতপূর্ব নজিরও বটে। একটি লোকাল ট্রেনের দখল লইয়া পর্যায়ক্রমে যে অবরোধ, পালটা-অবরোধ ও পুরুষদের গায়ের জোর দেখাইবার কুৎসিত প্রচেষ্টা দেখা গেল, তাহা উদ্বেগের। কারণ দাঙ্গাকারীরা সমাজ-বিচ্ছিন্ন নহেন, মাতৃভূমি উপলক্ষে রচিত দৃশ্যাবলিও এই সমাজেরই সযত্নলালিত মানসিকতার খণ্ডাংশ। সেই মানসিকতা দখলদারির। জাতপাত, ধর্ম, দেশ, রাজ্যের সীমা ছাড়াইয়া যাহার আগ্রাসন নারী বনাম পুরুষ দ্বৈরথে পর্যবসিত।

প্রশ্ন উঠিবে, একটি ঘটনা কি সমাজের দর্পণ হইতে পারে? বিশেষত যখন তাণ্ডবের নায়করা ছিল সুযোগসন্ধানী কিছু দুঃশীল ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। প্রশ্নটি সংগত। কিন্তু যাঁহারা সরাসরি আসরে নামেন নাই, কিন্তু দূর হইতে নীরব সমর্থনটুকু জোগাইয়াছেন, তাঁহারা এই দখলদারির মানসিকতা হইতে মুক্ত, এমনটা ভাবিবার বিশেষ কারণ নাই। উত্তেজনা চরমে উঠিলেও এই আপাত সু-শ্রেণিটি তাহাতে রাশ টানে নাই। ফলে, হিংসা বেলাগাম হইয়াছে। অনুমান করা যায়, মেয়েদের জন্য বিশেষ ট্রেন বা সংরক্ষিত কামরা তাঁহাদেরও ক্ষোভের কারণ, সেই ক্ষোভের কারণেই তাঁহারা ভাঙচুর ও আক্রমণে প্রশ্রয় দিয়াছেন। অন্যের আরাম সময়বিশেষে অসহ্য হইতে পারে, ওই স্বল্পকালীন সুখটুকুতে ভাগ বসাইবার দুর্দম প্রবৃত্তিও জাগিতে পারে। এই স্বার্থপরতাটুকু বোঝা কঠিন নহে। কিন্তু বেয়াড়া প্রবৃত্তিকে শাসন করিবার শিক্ষা সামাজিক শিষ্টাচারের অন্তর্গত। অধুনা এই অভ্যাস মানুষ আবর্জনাজ্ঞানে ত্যাগ করিতে ব্যস্ত। কেবল মাতৃভূমি লোকালের গুটিকতক কামরাতেই নহে, জনজীবনে সর্বত্র ইহার অসংখ্য নমুনা প্রকট। বোঝা সহজ যে, অসংযমের শিকড় সমাজমানসের গভীরে বিস্তৃত। আশঙ্কা, ভবিষ্যতে তাহা আরও গভীরে প্রবেশ করিবে।

আশঙ্কাই অবশ্য শেষ কথা নহে। ঘোর অন্ধকারের শেষে ক্ষীণ একটি আলোর রেখা পড়িয়া থাকে। ‘মাতৃভূমি’তে তাহা দেখা গিয়াছে। রাখিবন্ধনের দিন ভূতপূর্ব রণক্ষেত্রগুলিতে উৎসব পালিত হইয়াছে। যুযুধান দুই পক্ষ মিষ্টিমুখ করিয়াছে। কিন্তু এক দিনের সুখচ্ছবির উপর ভরসা করিয়া বসিয়া থাকিলে চলে না। কারণ নূতন অশান্তিতে উসকানি দিবার কাজটি সহজ। একে তো পরিশ্রম আর সময় খরচের বালাই নাই, তদুপরি, সম্ভব-অসম্ভব গুজব ছড়াইয়া বাজার গরম করিবার সুযোগ এ দেশে অতি সুলভ। ‘লেডিজ স্পেশাল’-এর ক্ষেত্রে এই ধারার পুনরাবৃত্তি রোধ করিতে চাহিলে সতর্ক ও তত্পর থাকা দরকার। তাহা অবশ্যই সম্ভব। রাখিবন্ধন প্রমাণ করিয়াছে, সমস্যার সমাধান ভিনগ্রহ হইতে আমদানির প্রয়োজন নাই, তাহার উপায় মানবসমাজেরই মস্তিষ্কপ্রসূত হইতে পারে। এ ক্ষেত্রে সেই উপায়ের প্রথম ও প্রধান শর্ত: বোঝাপড়ার মনোভাব। বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনীটুকু না ছাড়িবার মানসিকতাটি বিসর্জন দেওয়া সর্বাগ্রে জরুরি। মাতৃভূমি এবং পিতৃভূমি, দুই তরফেরই। কেবল ট্রেনের কামরায় বা রেল স্টেশনে নয়, জীবনের অন্য সহস্র পরিসরেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE