Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

যোগী-তন্ত্র

ত বে এই বার উত্তরপ্রদেশ ‘হর হর মোদী’ হইতে ‘হর হর যোগী’-তে উত্তীর্ণ হইল। খুবই গুরুতর এই উত্তরণ, দারুণ প্রতীকীও বটে। কেন্দ্রে রাজ্যে শাসক দল বিজেপিকে আর হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথাটি রাখঢাক করিয়া বলিতে হইবে না।

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ত বে এই বার উত্তরপ্রদেশ ‘হর হর মোদী’ হইতে ‘হর হর যোগী’-তে উত্তীর্ণ হইল। খুবই গুরুতর এই উত্তরণ, দারুণ প্রতীকীও বটে। কেন্দ্রে রাজ্যে শাসক দল বিজেপিকে আর হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথাটি রাখঢাক করিয়া বলিতে হইবে না। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের অতিপ্রিয় শব্দবন্ধটি তিনি নিশ্চয়ই কোনও মতে অবহেলিত হইতে দিবেন না! বিজেপি এত দিন আরএসএস ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলিকে পিছনে রাখিয়া রাজনীতি ও রাজনীতিক দিয়া বকলমে হিন্দুত্বের ঢাক পিটাইত, এই বার সেই দ্বিচারিতা ঘুচিল। গোরক্ষপুরের মহন্ত পুরোহিত মন্দিরের দালান ও বিধানসভার সিংহ-আসন, যুগপৎ দুই দায়িত্ব লইলেন, ধর্ম ও রাষ্ট্রের ব্যবধান মুছিয়া দিয়া সর্বময় কর্তা হইলেন। কেবল গণতন্ত্র নয়, আধুনিক যে কোনও তন্ত্রই ধর্ম ও রাজনীতির দূরত্ব মানিতে চাহে। উত্তরপ্রদেশের আপাতত সে দায় নাই। ভারত কত দিনে হিন্দু রাষ্ট্র হইবে জানা নাই, কিন্তু উত্তরপ্রদেশের মন্দির রাজ্য হইবার পথ এখন প্রশস্ত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কি এই জন্যই এত জন উন্মুখ বিজেপি নেতাকে ছাড়িয়া যোগী আদিত্যনাথকে বাছিয়া লইলেন? বিস্তর আলাপ-অনুমান সে বিষয়ে। আরএসএস-এর জমি ইহাতে শক্ত হইল, নাকি পাল্টা হিন্দুত্ব-মেরু তৈরির সম্ভাবনা বাড়িল, সেই আন্দাজি ঢিলও মারা চলিতেছে। অনুমান ও আন্দাজ মুখরোচক হইলেও তাহার উপর তত্ত্বের সৌধ রচনা চলে না। মোদী ঠিক কী চাহিতেছেন, যাহা চাহিতেছেন তাহা তিনি পাইবেন কি না, ইহা যদি একটি কূট চাল হয়, তবে এই চালে বাজি মাত হইবে কি না, হিন্দুত্বের রথ দুরন্ত বেগে ছুটিবে কি না, না কি বাড়াবাড়িতে রথের গতি রুদ্ধ হইবে: আপাতত প্রশ্নমাত্র।

প্রশ্নই থাকুক, কেননা এত দিন নানা রকম নেতিবাচক পূর্বাভাস ব্যর্থ করিয়া দিবার অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন নরেন্দ্র মোদী। কয়েক দিন আগেই এই রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারের যে ছবি দেখা গিয়াছিল, তাহাতে বিজেপির বিপুলাকার জয় কিংবা যোগীর বিপুল উত্থান, কোনওটিরই কল্পনা সহজ ছিল না। কিন্তু সহজকে কঠিন করিয়া কঠিনকে সহজ করিবার এক আশ্চর্য রাজনীতি মোদী অধীত করিয়াছেন। তাঁহার এই অপ্রত্যাশিতের রাজনীতির দৌলতেই উত্তরপ্রদেশের মতো বিচিত্র জনমানচিত্রবিশিষ্ট প্রদেশেও গৈরিক বসন পরিহিত মহন্ত মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথবাক্য উচ্চারণ করিলেন, শপথের প্রতিটি বাক্যের পর সমর্থকবৃন্দ ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে আত্মহারা হইয়া পড়িলেন। ভারতীয় গণতন্ত্রে ইহা একটি গুরুত্বমণ্ডিত মুহূর্ত।

বাস্তবিক, এই মুহূর্তে উত্তরপ্রদেশকে কেবল ভারতীয় গণতন্ত্রের নয়, বিশ্ব গণতন্ত্রেরই বিশিষ্ট পরীক্ষণাগার রূপে দেখিতে হইবে। জনসংখ্যার দিক দিয়া দেশের বৃহত্তম রাজ্যটি ঐতিহ্যগত ভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদের আধার, হিন্দুত্বের চাবিকাঠি। কিন্তু একই সঙ্গে ভারতের অন্যতম বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও দলিত জনসমাজের বাসও তো এ রাজ্যেই। দলিত রাজনীতির প্রবল উত্থান এই রাজ্যই দেখিয়াছে। একাধিক দশক ধরিয়া টানা অনুন্নত হিন্দু ও দলিতদের রাজনৈতিক দল এই রাজ্যেই শাসন করিয়াছে। সেখানে উচ্চবর্ণ হিন্দুত্ববাদের অভিযান এখনও অবধি এত দূর সফল, ইহাই অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। তাহার পর যদি উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের চরম রাজনৈতিক উচ্চতা আগামী পাঁচ বৎসর এখানে সাফল্যের মুখ দেখে, তবে বলিতে হইবে, ভারত ইতিমধ্যেই গণতন্ত্রে একটি অভিযোজন ঘটাইতে বসিয়াছে। সামাজিক শীর্ষবিন্দুর হেজিমনি বা সর্বাত্মক চেতনা কী ভাবে ক্ষমতার সাহায্যে সমাজের নিচু স্তরগুলিতে চুঁয়াইয়া নামানো যায়, তাহার পরীক্ষানিরীক্ষা চলিতেছে। যোগী আদিত্যনাথের ভবিষ্যৎ সেই পরীক্ষণের সাফল্য বা ব্যর্থতা স্থির করিয়া দিবে। সন্দেহ নাই, তাহা বড় পরীক্ষা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE