ক্ষোভ চলছে। কলকাতা, ৮ অক্টোবর। ছবি: পিটিআই
৮ অক্টোবর আনন্দবাজারে প্রকাশিত ‘সে দিনের আন্দোলন ঘরে ঢুকে এসেছিল’ প্রবন্ধটি পড়লাম। গৌতম ভদ্র ২০ সেপ্টেম্বরের ছাত্রদের মহামিছিল কী ভাবে তাঁর জীবনের সমৃদ্ধ করেছে, তার বর্ণনা দিয়েছেন। পূর্বে মৈনাক বিশ্বাসের লেখাতেও (৩০ সেপ্টেম্বর) এই ধরনের বর্ণনা পড়েছি। গৌতম ও মৈনাক দু’জনেই আমার প্রিয় মানুষ ও বন্ধু। তাঁদের অভিজ্ঞতাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করি। ওই মিছিলটি সম্বন্ধে আমার কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু দূরে বসেও ‘হোক কলরব’ স্লোগানটির সৃষ্টিধর্মিতা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। তা ছাড়া শান্তিনিকেতন-ঢাকা-কলকাতার ছাত্রসমাজকে এই দু’টি কথা যে-ভাবে একসূত্রে বেঁধে দিয়েছিল, সেই ঐক্যের বোধকেও দূর থেকে মনে মনে কুর্নিশ করেছি। সুতরাং, মিছিলে পা মিলিয়ে অনেকেই যে অভিজ্ঞতা-সমৃদ্ধ বোধ করেছিলেন, এ নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। বক্তব্য তো নেই-ই।
কিন্তু ধন্দে পড়লাম গৌতমের লেখায় ৩০ সেপ্টেম্বরের আনন্দবাজারে প্রকাশিত আমার একটি রচনার বিরুদ্ধে কিছু বিস্ময়কর যুক্তি, তথ্য ও তির্যক উক্তির সমাবেশ দেখে। আমার প্রবন্ধে নাকি ‘অভিভাবকসুলভ স্নেহে ও প্রাজ্ঞতার সূত্রে’ মিশেল ফুকোর কথা তুলে ধরা হয়েছে। ‘অভিভাবকসুলভ স্নেহ ও প্রাজ্ঞতার সূত্র’ গৌতম পেলেন কোথায়? ‘প্রাজ্ঞ’ কথাটির আভিধানিক অর্থ ‘বিজ্ঞ, দক্ষ, চতুর’ এই সব। আমি তো এর একটি বলেও নিজেকে দাবি করিনি! আর ‘অভিভাবকসুলভ স্নেহ’? স্পষ্টতই বলেছিলাম যে, আমাকে কেউ ছাত্রদের ‘গার্জেন’-এর সুরে উপদেশ দিতে বললে মুশকিলে পড়ে যাই, কারণ যৌবনে ও পরবর্তী কালে আমি তো অনেক সময় মিছিলেই হেঁটেছি।
বুঝতে পারছি যে ‘অভিভাবকসুলভ স্নেহ ও প্রাজ্ঞতা’র অভিমান আমার অভিপ্রেত না হলেও, পাঠক গৌতমের কানে তা বেজেছে। এখানে বলা ও শোনার তফাতের প্রশ্ন উঠে পড়ে। ছাপার অক্ষর মূক, তাতে ‘কণ্ঠস্বর’ যে-ভাবে প্রক্ষিপ্ত হয়, তা নানা মানুষের কানে নানা ভাবে শোনাতে পারে। গৌতম যেখানে অভিভাবকত্ব ও প্রাজ্ঞত্বের সুর শুনেছেন, সেই একই রচনা পড়ে অন্য কিছু সমভাবে শ্রদ্ধেয় কলকাতার মানুষ আমাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। গৌতমকে আমার নিশ্চয়ই বুঝিয়ে দিতে হবে না যে, একই বয়ান ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছে ভিন্ন রকম শোনায়। এই কারণেই গৌতমের প্রিয় ঐতিহাসিক ই পি টমসন মশাই একটা কথা বলতেন: ঐতিহাসিককে পুরনো দলিল থেকে কী ভাবে অতীতের কণ্ঠস্বর অবিকৃত ভাবে শুনতে হবে, তা নিয়ে রীতিমতো কান-খোলার পরিশ্রম করতে হয়।
এ বারে আসি জ্ঞানার্জনের আনন্দের কথায়। কলকাতার মতো শহরে যেখানে রমন-কৃষ্ণন সাহেব গবেষণা করে গেছেন, সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহার মতো মানুষেরা বিচরণ করেছেন, সুনীতি চট্টোপাধ্যায়-যদুনাথ সরকার প্রমুখেরা জীবন কাটিয়ে গেছেন, যেখানে আমাদের যৌবনে তারকনাথ সেন বা অমল রায়চৌধুরীর মতো জ্ঞানতপস্বীরা আদর্শের আলোয় নিজেদের জ্বালিয়ে আমাদের জীবন উজ্জ্বল করে গেছেন, সেখানে কথাটি এত খারাপ শোনাবে, তা কোনও দিন ভাবিনি। ই পি টমসন প্রসঙ্গেও গৌতমের কথায় খানিকটা বিস্মিত না হয়ে পারিনি। তিনি লিখেছেন, ‘জ্ঞানার্জনের শ্রেষ্ঠ পর্যায়ে টমসন সব গবেষণা ছেড়েছুড়ে দশ বছর ধরে পারমাণবিক যুদ্ধ ও অস্ত্রভাণ্ডার তৈরি করার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেছেন, সময় নষ্ট হয়েছে বলে মনে করেননি।’ কথা হচ্ছিল ছাত্রদের রাজনীতি করা নিয়ে। টমসন যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে কেমব্রিজে ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন, তখন কি দিনের পর দিন ক্যাম্পাসে অশান্তি হয়ে ক্লাস বন্ধ থাকত? (অথচ তখনই কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হন টমসন।) আর টমসন তো বেশি দিন চাকরিও করেনি, মাত্র ছ’বছর পড়েছিলেন ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ে, তার পর ষাটের দশকের শেষে বা সত্তরের গোড়ায় ইস্তফা দেন। তাঁর সংগতি ছিল, নিজের পয়সায় সংসার চালাতেন। এমনকী যে আশির দশকের কথা লিখেছেন গৌতম, যখন তিনি পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে রত ছিলেন, তখনও তিনি গুটি তিন-চার বই লেখেন ওই সব বিষয়ে। সেগুলো কি কোনও গবেষণা না করেই লিখেছিলেন টমসন? ১৯৯৩ সালে অগস্ট মাসে টমসনের মৃত্যু হয়। তার পূর্বেই তাঁর ব্লেক সম্পর্কিত বইটি শেষ করে গিয়েছিলেন। সে বই নিয়ে যে আশির দশকে কোনও গবেষণাই করেননি টমসন, সব ছেড়েছুড়ে দিয়েছিলেন? গৌতমের কাছে আরও তথ্যনিষ্ঠতা প্রত্যাশা করি।
স্বাধীনতা আন্দোলন (যাতে নির্মল বসু যোগ দিতেন), মায় এমনকী ষাটের দশকের নকশালদের দেশকে চিরতরে শোষণমুক্ত করার যে রাজনীতি, তা জীবনের বৃহৎ ক্ষেত্রে বড় মাত্রার প্রশ্নে মহতী প্রচেষ্টার অঙ্গ। পারমাণবিক অস্ত্র-বিরোধী আন্দোলনও তাই। এতে নানা জাতের ও পেশার মানুষ শামিল হবেন, এমনকী ছাত্ররাও তাতে আশ্চর্য কী? আর এই সব বড় উদ্দেশ্যের আন্দোলন অনেক ছোট স্থানীয় আন্দোলনকে গিলে ফেলে, বা অনেক সময় স্থানীয় আন্দোলনই এর প্রথম স্ফুলিংগ হয়ে দেখা দেয়, এ সবই যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু এখনও পর্যন্ত যত দূর জানি, যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলন দেশ পরিবর্তনের আন্দোলন হিসেবে নিজের পরিচয় দেয়নি। এটি এমনকী সরকার পরিবর্তনের আন্দোলনও নয়। পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ ছিল এ আন্দোলন, ভিসি পরিবর্তনই ছিল দাবি। পুলিশি প্রহারেরও মূলে ছিল পৃথিবীর যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু দৈনন্দিন সমস্যা যৌন হেনস্থা বা নির্যাতন। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে প্রশাসনিক পদক্ষেপে এর সন্তোষজনক সমাধান করা হত, তা হলে এত ক্লাস বন্ধ করতে হত না, শহরব্যাপী আন্দোলনেরও প্রয়োজন হত না। বিদেশে এই দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানের খোঁজে সব সময়ই সঠিক সমাধান হয় বলছি না, আবার প্রায় চল্লিশ বছরের ছাত্র ও মাস্টারজীবনে এক দিনও ক্লাস বন্ধ হতে দেখিনি। আমাদের দেশেও একটি ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল প্রশাসনিক ব্যবস্থা কেন চালু করা যাবে না, তাই নিয়ে দুঃখ ও খেদ প্রকাশ করছিলাম।
জ্ঞানবিজ্ঞানের সাধনায় একাগ্রতার প্রয়োজন হয়। ক্যাম্পাসের নিত্য অশান্তি ঘটলে এই একাগ্র মনোভাব অর্জন একেবারে অসম্ভব না হলেও শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। সমাজবিজ্ঞানের কয়েকটি শাখায়, যেখানে অনেক টেকনিক্যাল জিনিস শিখতে হয় না, সেখানে তবু একটি উপায় আছে: ‘পরে পড়ে নেব’-র রীতি ধরে খানিকটা এগনো যায়, অন্তত করে যাওয়া যায়। কিন্তু এ কথা তো সুবিদিত যে, জ্ঞানের, বিশেষত বিজ্ঞান ও অংকের এমন অনেক শাখা আছে, যেখানে মানুষ তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজ তাঁর যৌবনে বা অল্প বয়সেই করেন। বয়স হলে, মস্তিষ্কের জোর কমে এলে, সেই সব শাখায় অত ভাল কাজ সচরাচর করা যায় না।
যৌবন প্রতিবাদের শ্রেষ্ঠ সময় নিশ্চয়ই, একই সঙ্গে শিক্ষার্জনেরও শ্রেষ্ঠ সময়। ব্যক্তিমানুষ তাঁর সময় কী অনুপাতে বাঁটবেন, সেটি তাঁর নিজস্ব পছন্দকথা। কিন্তু সময় যেহেতু বাঁধা, একটিতে অনেক বেশি সময় দিলে অন্যটির জন্য সময়ের অভাব হওয়াটাই স্বাভাবিক। ছাত্র-রাজনীতিতে কোনও সাধারণ অর্থে ‘সময় নষ্ট’ হয়, এ কথা এক বারও বলিনি। আমি ‘সময় নষ্ট’ শব্দবন্ধটির পূর্বে একটি অন্য কথা বসিয়েছিলাম। বলেছিলাম ‘পড়াশুনোর সময় নষ্ট’-র কথা। তা-ও বলেছিলাম আমার নিজের অভিজ্ঞতার সম্বন্ধেই।
কিন্তু একটা কথা এখনও বলি: আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সুষ্ঠু ভাবে চললে একটি যৌন-নিগ্রহের অভিযোগ প্রশাসনিক ভাবেই যথাযথ বিচার পেতে পারত। পুলিশি নির্যাতন হত না, ছাত্রছাত্রীদেরও পথে নামতে হত না। এর মধ্যে প্রাজ্ঞতার দাবি, ছাত্রদের অভিভাবক হবার ইচ্ছে, এ সব কিছুই নেই। আমি প্রাজ্ঞ নই, প্রৌঢ়। নিজের ছাত্রজীবন ও মাস্টারি অভিজ্ঞতায় সাধারণ বুদ্ধিতে যা শিখেছি, তা-ই বলেছি। কেউ দ্বিমত হলে খারাপ লাগে না, কিন্তু কান খোলা রেখে আমার কথাটি শুনে ও অনুধাবন করে দ্বিমত হলে খুশি হই আরও।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy