Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

যে রঙেরই হউক

অ সহিষ্ণুতা বলিলে ইদানীং গৈরিক বর্ণের কথাই প্রথমে মনে পড়ে। কিন্তু অসহিষ্ণুতা যে কোনও রঙের হইতে পারে। সম্প্রতি পাকিস্তানের দুই সাহিত্যিক ইনদওর সাহিত্য উৎসবে যোগ দিতে আসিয়া যাহা করিলেন, তাহা সহিষ্ণুতার পরিচয় দেয় না।

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৪৩
Share: Save:

অ সহিষ্ণুতা বলিলে ইদানীং গৈরিক বর্ণের কথাই প্রথমে মনে পড়ে। কিন্তু অসহিষ্ণুতা যে কোনও রঙের হইতে পারে। সম্প্রতি পাকিস্তানের দুই সাহিত্যিক ইনদওর সাহিত্য উৎসবে যোগ দিতে আসিয়া যাহা করিলেন, তাহা সহিষ্ণুতার পরিচয় দেয় না। কানাডা-নিবাসী পাকিস্তানি লেখক তারেক ফাতাহ্ এই সাহিত্যসভায় অভিযোগ করিয়াছেন যে, পাকিস্তান বহু উগ্রপন্থীকে আশ্রয় দিয়াছে। তিনি আরও বলিয়াছেন যে দেশভাগের পূর্বে করাচি সহ বিভিন্ন স্থানে যে বহুবর্ণ সংস্কৃতির চল ছিল, এখন তাহা প্রায় নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছে। যথা, পাকিস্তানে গুজরাতি, সিন্ধি, বাঙালি বা পশ্‌তু ভাষার সংবাদপত্র এখন আর প্রকাশিত হয় না, অথচ এই ভাষাগুলি এক একটি অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান ছিল। তাঁহার মতে, এই সমস্যা সমাধানের জন্য আগে সমস্যা মানিয়া লইয়া প্রয়োজন। এই বক্তব্য শুনিয়া সভায় উপস্থিত পাকিস্তানের দুই সাহিত্যিক সভা ত্যাগ করিয়া চলিয়া যান। ‘পাকিস্তানের অপমান’-এর প্রতিবাদে এই ওয়াকআউট। ইহাতে অসহিষ্ণুতাই প্রকট হইয়াছে।

প্রশ্ন উঠিবে, কেন? কেহ তো স্বদেশের সমালোচনায় আপত্তি করিতেই পারেন, অপমানিত বোধ করাও অন্যায় কিছু নহে। নিশ্চয়ই। কিন্তু অপমানবোধের প্রকাশ কীরূপ হইবে? অপমানের প্রতিবাদ জানাইবার সদুপায় কী? দুই সাহিত্যিক সভা ত্যাগ করিয়া প্রমাণ করিতে চাহিলেন যে, পাকিস্তান-বিরোধিতা মানিতে তাঁহারা নারাজ। অথচ সেই মতটিই যদি তাঁহারা সভায় উপস্থিত থাকিয়া প্রকাশ করিতেন, একটি যথার্থ বিতর্ক হইতে পারিত। তাঁহারা পরে তথ্য দিয়াছেন যে, এখনও করাচি হইতে গুজরাতি ও সিন্ধি ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। তাঁহারা সভায় উপস্থিত থাকিয়া এই তথ্য জানাইলে উপস্থিত সকলে অবহিত হইতেন। তাহার পরেও সংখ্যালঘুর ভাষার প্রতি পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরাগের অভিযোগ থাকিত, কিন্তু তাহা লইয়া আলোচনাও চলিতে পারিত। কেবল তথ্যই নয়, তাঁহাদের অভিমত বা আবেগও তাঁহারা সভায় প্রকাশ করিতে পারিতেন। পাইকারি ভাবে পাকিস্তান সম্পর্কে সন্ত্রাসীদের মদত দিবার অভিযোগ যে অনৈতিক, সেই বার্তাও পৌঁছাইয়া দেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেই সুযোগ তাঁহারা প্রত্যাখ্যান করিলেন। তাহার কারণ, তাঁহারা মনস্থির করিয়াই ফেলিয়াছিলেন যে অন্য মত শুনিবেন না। এই না শোনাটাই অসহিষ্ণুতা। যে কোনও অসহিষ্ণুতাই ক্ষতিকর, কারণ তাহা আলোচনা ও বিতর্কের পথ রোধ করে।

এ ক্ষেত্রে তাহা দ্বিগুণ ক্ষতিকর। কারণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চিন্তা ও মননের পরিসর যাহাতে সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত হয়, তাহাই ছিল এই সভার উদ্দেশ্য। বিশেষত ভারত-পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সেই লেনদেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সভা ছিল তাহার একটি প্রকৃষ্ট পরিসর। মনে রাখিতে হইবে, শিল্পী-সাহিত্যিকরা সমাজের অগ্রপথিক। অন্য দেশের সহিত স্বদেশের অনন্য যোগসূত্র। এবং স্বদেশ ও স্ব-সমাজের প্রতিভূও। তাঁহারা অন্য দেশে আপন সমাজের যে রূপ তুলিয়া ধরিবেন, অন্য দেশের মানুষ তাহা বিশ্বাস করিতে চাহিবে। ভিন্ন মতের প্রতিবাদে তথ্য ও যুক্তি সহকারে তর্ক না করিয়া সভা ত্যাগ করিলে বিরূপ মনোভাবই উত্সাহিত হয়, অনেকেই বলিবার সুযোগ পায়, ‘উহারা ওই রকমই, অসহিষ্ণুতাই উহাদের স্বভাব।’ ইনদওরের সাহিত্যসভায় তাহাই হইল। আরও এক বার প্রমাণ হইল, অসহিষ্ণুতা যে রঙেরই হউক, ভয়ানক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE