Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

যাহার যাহা কাজ

কা হারও হাত দুইটি পিছমোড়া রাখিয়া চুল বাঁধিতে বলিলে অন্যায় হয়। দায়িত্ব যাহার, সেই দায়িত্ব পালনের জন্য আবশ্যক অধিকারও তাহার প্রাপ্য। এই শর্তটি না মানিলে কেবল ন্যায় লঙ্ঘিত হয় না, কাজও পণ্ড হইতে পারে। মনিটারি পলিসি বা মুদ্রা নীতির সংস্কার সাধনে কেন্দ্রীয় সরকারের নূতন উদ্যোগটি তেমন আশঙ্কা জাগাইয়াছে। অনেক দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রধান দায়িত্ব মূল্যস্তর নিয়ন্ত্রণ। ভারতেও।

শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

কা হারও হাত দুইটি পিছমোড়া রাখিয়া চুল বাঁধিতে বলিলে অন্যায় হয়। দায়িত্ব যাহার, সেই দায়িত্ব পালনের জন্য আবশ্যক অধিকারও তাহার প্রাপ্য। এই শর্তটি না মানিলে কেবল ন্যায় লঙ্ঘিত হয় না, কাজও পণ্ড হইতে পারে। মনিটারি পলিসি বা মুদ্রা নীতির সংস্কার সাধনে কেন্দ্রীয় সরকারের নূতন উদ্যোগটি তেমন আশঙ্কা জাগাইয়াছে। অনেক দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রধান দায়িত্ব মূল্যস্তর নিয়ন্ত্রণ। ভারতেও। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এই দায়িত্বটিকে একটি আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হইয়াছে। কেন্দ্রীয় সরকার এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মধ্যে একটি বোঝাপড়া হইয়াছে। মুদ্রা নীতির কাঠামো সংক্রান্ত বোঝাপড়া। ভোগ্যপণ্যের মূল্য সূচক কতটা বাড়িতে দেওয়া হইবে, তাহার লক্ষ্যমাত্রা বাঁধিয়া দিয়া সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে দায়বদ্ধ করা হইয়াছে এই ‘চুক্তি’তে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হইলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে জবাবদিহি করিতে হইবে, প্রতিকারের বিশ্বাসযোগ্য পরিকল্পনা জানাইতে হইবে। অর্থাত্‌, রীতিমত পাশ-ফেলের পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় সফল হইবার জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হাতে প্রধান অস্ত্র: সুদের হার। মূল্যস্তর অতিরিক্ত ঊর্ধ্বগামী হইলে সুদ যথেষ্ট চড়া রাখিয়া রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বাজারে চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে, তাহার ফলে বাজারদর নিয়ন্ত্রিত হয়। এই কৌশল ত্রুটিহীন নহে, অনেক সময় ইহাতে কাঙ্ক্ষিত ফল মেলে না, কিন্তু ইহার সামগ্রিক কার্যকারিতা প্রমাণিত, এবং ইহার অধিক কার্যকর কোনও অস্ত্র কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের তূণীরে নাই। সুতরাং এই অস্ত্র সন্ধানের অধিকার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হাতেই থাকা বিধেয়।

আশঙ্কা দেখা দিয়াছে যে, কেন্দ্রীয় সরকার সেই অধিকার হরণ করিতে চাহে। অর্থ মন্ত্রক একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রস্তাব আপন ওয়েবসাইটে তুলিয়া দিয়াছে। সেই প্রস্তাবের অন্যতম প্রধান প্রতিপাদ্য: সুদের হার নির্ধারণে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের কোনও বিশেষ ক্ষমতা থাকিবে না। মুদ্রা নীতি নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি থাকিবে, তাহার অধিকাংশ সদস্যকেই নিয়োগ করিবে কেন্দ্রীয় সরকার, সেই কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুদের হার স্থির হইবে। ইহার অর্থ অতি স্পষ্ট: অর্থ মন্ত্রক পরোক্ষে সুদের হার স্থির করিবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডানা ছাঁটা হইবে। কেন্দ্রীয় সরকার বলিতেছে এমন কোনও অভিসন্ধি তাহাদের নাই, তাহারা প্রস্তাবটি পেশ করিয়াছে মাত্র। কিন্তু অভিসন্ধি থাকিলেই তাহা সরল ভাবে স্বীকার করিতে হইবে, সরকারি আচরণবিধিতে এমন কথা নাই, বর্তমান জমানায় তো মোটেও নাই।

ফাঁকা আশ্বাসে লাভ নাই, কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তব্য স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দেওয়া যে মুদ্রা নীতি তথা সুদের হার নির্ধারণের স্বাধীন ক্ষমতা রিজার্ভ ব্যাঙ্কেরই থাকিবে। অর্থ মন্ত্রকের হাতে এই ক্ষমতা তুলিয়া দিলে সুদের হারের উপর নির্বাচনী রাজনীতি এবং দলীয় স্বার্থের প্রভাব পড়িবার সম্ভাবনা অতি প্রবল। বিশেষত, সুদের হার কম রাখিয়া সরকারি ঋণ এবং ব্যয় বাড়াইবার সম্ভাবনা। অর্থনীতির স্বাস্থ্যের পক্ষে তাহা অতিমাত্রায় ক্ষতিকর। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা তাহার গভর্নর নিশ্চয়ই অর্থ মন্ত্রকের সহিত আলোচনা করিবেন, যেমন আলোচনা করিবেন অন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞদের সহিত। বস্তুত, সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থায় সাম্প্রতিক কালে কিছু হানি ঘটিয়াছে, তাহার সংশোধন অত্যাবশ্যক। কিন্তু আলোচনা আর হস্তক্ষেপ এক নহে। এই বিষয়ে মার্কিন ফেডারাল রিজার্ভ-এর দৃষ্টান্তটি মূল্যবান। ফেড কার্যত সার্বভৌম, কিন্তু মার্কিন প্রশাসন এবং আইনসভার সংশ্লিষ্ট কমিটির সহিত তাহার আলাপ-আলোচনা চলিতেই থাকে। তাহাই গণতন্ত্রের পথ। অধিকার লইয়া রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সহিত রেষারেষি চালাইলে ভারতীয় অর্থনীতির উপকার হইবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE