একমনে একটা মেল টাইপ করছিলেন তিরিশ-অনূর্ধ্ব ঝকঝকে নৌসেনা অফিসার। সোনালি চুলের নীচে চোখমুখে খুশির আভাস। রাত তখন দশটা বেজে কুড়ি। দিনভর খাটুনি তাঁর কম যায়নি। পারস্য উপসাগর দিয়ে ভেসে চলেছে আঠারো-তলা মার্কিন রণতরী, বোমারু বিমানবাহী ইউএসএস কার্ল ভিনসন। ন’তলায়, জনসংযোগ বিভাগের দফতরে একটি কম্পিউটারে বসে চিঠিটা লিখছেন আমেরিকার ওহায়ো প্রদেশের যুবক, লেফটেন্যান্ট ট্রেভর ডেভিডস।
‘কাকে লিখছি জানেন? আমার বাগদত্তাকে। প্রায় এগারো হাজার কিলোমিটার দূরে আছে ও। রোজ কাজ শেষে এই সময়ে ওকে একটা মেল করি। তার আগেই ইনবক্সে ঢুকে দেখি, ওর পাঠানো মেল পড়ে আছে। ওটা পড়ে নিয়ে উত্তর দিই। এটাই আমার সারা দিন কাজের পর তৃপ্তি, বিশ্রাম, আরাম,’ বলেন ট্রেভর। আগামী বছরই বিয়ে করার কথা দু’জনের।
ঠিক তখন এর তিন তলা উপরে, বারো তলায়, এয়ারক্রাফট কেরিয়ার-এর ফ্লাইট ডেক থেকে একের পর এক উড়ে যাচ্ছে মিসাইল ও রকেট বোঝাই হর্নেট, সুপার হর্নেট-এর মতো বোমারুরা। ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিদের খতম করতে। যুদ্ধ চলছে যুদ্ধের মতো, জীবন চলছে জীবনের মতো।
পর দিন সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ দু’টি ফাইটার জেট যখন চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে ওড়ার, সেই সময়েই আটতলার হ্যাঙার বে-তে খাবার, কাপড়চোপড়, ওষুধপত্র-সহ প্রয়োজনীয় রসদ কপিকলের কায়দায় লিভার-এর সাহায্যে টেনে আনা হচ্ছে পাশাপাশি চলা ‘রেনিয়ার’ নামে মার্কিন নৌবাহিনীর এক জোগানদার জাহাজ থেকে। ওই জাহাজই পাইপলাইনের মাধ্যমে কার্ল ভিনসনে সরবরাহ করছে জ্বালানি। কয়েক ঘণ্টায় তেরো লক্ষ গ্যালন জ্বালানি ভরা হল রণতরীতে। আমরা তখন মাঝসমুদ্রে, সৌদি আরব ও ইরানের মাঝামাঝি। সঙ্গী এক সাংবাদিকের চালু রাখা স্মার্ট ফোনে হঠাত্ই কয়েক মুহূর্তের জন্য ইরানের টাওয়ার-এর সঙ্কেত এল। এমনিতে মোবাইল সংযোগ মাঝসমুদ্রে মেলে না। বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে কার্ল ভিনসন-এর অফিসার ও অন্য সেনাকর্মীদের ভরসা ইন্টারনেট। তা ছাড়া, সিনেমার তিনটি এবং খবর বা তথ্য
সংক্রান্ত সাতষট্টিটি টিভি চ্যানেল দেখার সুযোগ রয়েছে জাহাজে বসে।
গত বছর অক্টোবরে পারস্য উপসাগরে পৌঁছেছিল কার্ল ভিনসন। আয়তন মোট সাড়ে চার একর। প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের থাকার ব্যবস্থা। ছোটখাটো একটা শহর যেন। যার বিপুল বিদ্যুতের জোগান দেয় দু’টি পারমাণবিক চুল্লি। সাধারণত প্রতি সপ্তাহে এক বার রসদের জোগান প্রয়োজন হয় কার্ল ভিনসনের। জোগানদার জাহাজ এসে কার্ল ভিনসনের গায়ে প্রায় গা লাগিয়ে যে সব জিনিসপত্র দিয়ে যায়, তার একটা অংশ, যেমন টাটকা সবজি ও ফল ওঠানো হয় নিকটবর্তী কয়েকটি বন্দর থেকে, বাকি সব কিছু আসে আমেরিকা থেকে। সাত তলায় রসুইঘর ‘অ্যাফট গ্যালি’তে দেখলাম, বিপুল জোগাড়যন্ত্র চলছে। আরও তিনটি রান্নাঘর আছে জাহাজে। অ্যাফট গ্যালিতেই দেখা হল রান্নাঘরের দায়িত্বপ্রাপ্ত, ফুড সার্ভিস অফিসার (মার্কিন নৌসেনার পরিভাষায়, চিফ ওয়ারান্ট অফিসার) ক্যাথরিন টমসনের সঙ্গে। বললেন, ‘কয়েকশো রকমের পদ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বানাই। বিফ স্টেক, লবস্টার, চিকেন উইং ফ্রাই জনপ্রিয়।’
লাঞ্চটাইম শুরু হতে দেরি নেই। পাকশালায় গাঢ় নীল পোশাক পরা এক যুবক শুধু লেটুস কুচিয়ে চলেছেন। অন্য এক জন বাঁধাকপি ও হোয়াইট সস দিয়ে স্যালাড বানাচ্ছেন। আর এক জন তরিবত করে কাটছেন সবুজ ও লাল ক্যাপসিকাম। রসুইঘরের আর একটু ভিতরে ঢুকে দেখা গেল, ময়দা, ডিম, মাখন ও চিনির একটি তাল দু’হাতে থেবড়ে চলেছেন চশমা পরা এক যুবক, বয়স তাঁর বড়জোর কুড়ি-একুশ। ‘কী করছেন?’ তাঁর জবাব, ‘কুকি তৈরি করছি।’ প্রতিটি রসুইখানায় একাধিক বেকারি রয়েছে। রান্নাঘরে ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যেই দায়িত্বপ্রাপ্ত এক জন হাতে একটি কাগজের টুপি ধরিয়ে সেটি পরতে বললেন। অবিকল আম আদমি পার্টির সাদা টুপি। যাতে চুল না উড়ে খাবারে পড়ে।
আমাদের, অতিথিদের, খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা সাততলার ক্যান্টিনে। প্রাতরাশ অবশ্য ছ’তলার ক্যান্টিনে। ক্যান্টিনগুলোকে ওঁরা বলেন ওয়ার্ডরুম। এ রকম পাঁচটি ওয়ার্ডরুম আছে বোমারু বিমানবাহী রণতরীতে। প্রতিটিতে বিপুল পরিমাণ আহার-সম্ভার। কী নেই? কোল্ড মিট, হরেক রকম রুটি, কেক, আমিষ ও নিরামিষ দু’রকম স্যুপ, মেন কোর্সে মাছ চিকেন বিফ পর্ক সিদ্ধ-সব্জি ভাত, অন্তত বিশ রকম পদের স্যালাড কাউন্টারে টুনা মাছ ও পাস্তাও, বিফ ভুনা-মুরগি মাছভাজার আলাদা কাউন্টার, পাঁচ-ছ’রকম ফল, পুডিং ব্রাউনি, তিন-চার রকম আইসক্রিম, ছ’রকমের সফট ড্রিঙ্ক, চা-কফি। যে যত খুশি খাও। প্রতিটি টেবলে সসই পনেরো রকম। ডিনারে বেকড ক্যাটফিশ খেতে গিয়ে চমকে গেলাম। ডায়মন্ড সাইজের মোটা মোটা ফিলে নুন আর যত্সামান্য সসে সাঁতলানো, তেল নামমাত্র, মশলাহীন। মুখে দিয়ে মনে হল, দেশি ভেটকি খাচ্ছি।
খেলেই তো শুধু হবে না, শরীরচর্চার জন্য জিম। বহু ট্রেডমিল, সাইকেল সার দিয়ে রাখা। ছ’তলায় বড়সড় দাঁতের ডাক্তারখানা। প্রত্যেককে বছরে এক বার দাঁত পরীক্ষা ও স্কেলিং করাতে হয়। একটি ছোটখাটো অপারেশন থিয়েটার আছে। চিকিত্সক জানালেন, অস্ত্রোপচারের সময়ে জাহাজের স্বাভাবিক গতিবেগ (ঘণ্টায় ৩০ নটিকাল মাইল) কমাতে বলা হয় এবং জাহাজ তখন যেন উত্তাল সমুদ্রে না থাকে। এভরিক বললেন, ‘সে দিন লোহার তার ছিটকে এক নৌসেনার তলপেটে লাগল। আমরা এখানেই অস্ত্রোপচার করলাম। তিনি এখন দিব্যি সুস্থ।’ ও হ্যাঁ, আছে ইঁদুরে কামড়ালে ইঞ্জেকশন নেওয়ার ব্যবস্থাও। জাহাজে ইঁদুর ও আরশোলার খুব উপদ্রব তো!
মার্কিন বিদেশ মন্ত্রকের আমন্ত্রণে কার্ল ভিনসন সফরে গিয়েছিলাম সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি হিসেবে। অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। অভিজ্ঞতাটা সত্যিই অন্য রকমের। এয়ারক্রাফ্ট ক্যারিয়ার বললে যে ছবিটা মনে আসে, টেলিভিশনের পর্দায় রণতরীর বুক থেকে ক্রমাগত যুদ্ধবিমানের উড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে যে ছবি আরও পাকা হয়, সেটাই একমাত্র নয়, তার সাজঘরে অন্য এক জগত্, অন্য এক জীবন।
সম্প্রতি একটা খবর চোখে পড়ল, কার্ল ভিনসন তার দায়িত্ব সেরে ফিরে গেছে ক্যালিফর্নিয়ার সান ডিয়েগোয়, প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে, নিজের ঘরে। আপাতত বিশ্রাম। এবং প্রতীক্ষা। আবার কখন কোন উত্তাল দরিয়ায় ডাক পড়বে, বারোতলার রানওয়ে থেকে উড়ে যাবে ঝাঁকে ঝাঁকে বোমারুরা, তিনতলা নীচে তরুণ সেনানী দিনের কাজ শেষে ইমেল পাঠাবেন মনের মানুষটিকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy