Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

রাবণের সিঁড়ি

দূরদূরান্তের কত মানুষকে টানিয়া আনিতেছে ভারতের তাজমহল, কুতব-মিনার, অজন্তা-ইলোরা, খাজুরাহো, বোধিবৃক্ষ, বিশ্বনাথের মন্দির। কিন্তু আর বেশি দিন নহে। ২০১৮ সালের পর এই দ্রষ্টব্যসমূহ বিস্মৃতিতে বিলীন হইতে চলিয়াছে, ভারত বলিতে বিশ্ববাসীর চোখে তখন কেবলই ভাসিবে ১৮২ মিটার উচ্চ বিশালাকার একটি মূর্তি, সর্দার বল্লভভাই পটেলের।

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

দূরদূরান্তের কত মানুষকে টানিয়া আনিতেছে ভারতের তাজমহল, কুতব-মিনার, অজন্তা-ইলোরা, খাজুরাহো, বোধিবৃক্ষ, বিশ্বনাথের মন্দির। কিন্তু আর বেশি দিন নহে। ২০১৮ সালের পর এই দ্রষ্টব্যসমূহ বিস্মৃতিতে বিলীন হইতে চলিয়াছে, ভারত বলিতে বিশ্ববাসীর চোখে তখন কেবলই ভাসিবে ১৮২ মিটার উচ্চ বিশালাকার একটি মূর্তি, সর্দার বল্লভভাই পটেলের। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবেই হউন আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবেই হউন, ইতিহাসে নরেন্দ্র মোদী যে একটি স্থায়ী ‘দাগ’ রাখিয়া যাইতে চাহেন, সকলেই তাহা অবগত। পটেলের মূর্তিই তাঁহার সেই বহুকাঙ্ক্ষিত দাগ। ক্ষমতার আসন নিশ্চিত হইয়াছে, বিজেপির রথ দিকে দিকে ছুটিতেছে, এই পরম সাফল্যের আবহে মোদী তাই দাগটি তৈরির দিকে মন দিয়াছেন, সাড়ম্বর ব্যবস্থাপনা আরম্ভ হইয়াছে। সর্দার পটেলের শতবর্ষ উদ্‌যাপনের অংশ হিসাবে গুজরাতের নর্মদা জেলায় সর্দার সরোবর বাঁধের নিকটে সাধু দ্বীপে মহানির্মাণকার্যের জন্য মতো নামী নির্মাণ সংস্থাকে সরকারি ভাবে দায়িত্ব অর্পণ করা হইয়াছে। ৫৭০০ টন ওজনের মূর্তির জন্য ৭৫০০০ কিউবিক মিটার সিমেন্ট, ১৮৫০০ টন স্টিল এবং ২২৫০০ টন ব্রোঞ্জ দেশের কেন্দ্র-প্রান্ত-প্রত্যন্ত হইতে দ্রুতবেগে সংগৃহীত হইতেছে।

এই পরিকল্পনার পিছনে যে প্রধানমন্ত্রী মোদীর বিরাট দূরদৃষ্টির ছড়াছড়ি, সন্দেহ নাই। কেবল ভারতের অন্যান্য পর্যটন-আকর্ষণ নহে, পৃথিবীর বহু বিখ্যাত আকর্ষণকেও ত্বরিতে ম্লান করিয়া দিবে এই অতুল কীর্তি। এই মহিমান্বিত মূর্তি আকারে মার্কিন দেশের স্ট্যাচু অব লিবার্টির দ্বিগুণ, এবং ব্রাজিলের রিয়ো ডি জেনেইরো-র বিশালাকার খ্রিস্টমূর্তির তিনগুণ। বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তিটি ধ্বস্ত হইয়া বাঁচিয়া গিয়াছে, নতুবা পটেলের সামনে বুদ্ধের পর্যটন-বাজারও টিমটিম করিত। মোদী ঠিকই ভাবিতেছেন, পর্যটনের যে সহসা-জোয়ার ফুলিয়া-ফাঁপিয়া ধাবন করিয়া আসিবে তাঁহার রাজ্যের কচ্ছ উপকূলে, তাহাতে ভারতের অর্থাগম যশাগম দুইই হইবে। চিনের প্রাচীরের সঙ্গে টেক্কা দিবে লৌহপুরুষের লৌহমূর্তি। পাকিস্তানের সীমান্ত বরাবর কঠোর জাতীয়তার প্রতীক-ব্যক্তিত্ব পটেলের সদাসমুন্নত উপস্থিতি মনে করাইয়া দিবে, কূটনীতিতে সূচ্যগ্র ভূমিও ছাড়িবার নয়।

এইখানেই মোদীর কৃতিত্ব। মূর্তি একখানা গড়িলেই তো হইল না। সে যত লম্বাই হউক না কেন, তাহার নিহিতার্থটির ভারটিই প্রবল হওয়া দরকার। তাহার জন্য দরকার এমন একখানি প্রতীক, যাহা সাত দশকের রাজনীতি-অর্থনীতির পাকচক্র ভুলাইয়া দিয়া আবার নূতন করিয়া এক সুর এক স্বরের জাতীয়তা জাগাইয়া তুলিতে পারে। গাঁধী, নেহরু, অম্বেডকরকে ফেল করাইয়া এইখানে বল্লভভাইয়ের জিত। ইতিহাসের সুবিবেচনাই বলিতে হইবে, তাঁহার অবয়বখানি দেশের বুকে প্রবল ও একক ভাবে বিরাজ করিতে চলিয়াছে। গাঁধী-নেহরুর মতো অস্তিত্বের সংশয়ে পূর্ণ এবং জাতীয়তার দ্বন্দ্বে দীর্ণ চরিত্রদের মূর্তি দেশের এখানে ওখানে নেহাত অনুল্লেখযোগ্য ভাবে ছড়াইয়া থাকিতেছে। তাঁহারা একত্বের চরম সাধনা করেন নাই, তাঁহাদের ভাগ্যে একক উচ্চতাও জোটে নাই। তবে কিনা, বল্লভভাই যত বড় ‘লৌহপুরুষ’ হউন না কেন, গাঁধীজির কিছু প্রভাব তাঁহার মানসলোকে পড়িয়াছিল। তাঁহার ব্যক্তিগত স্বভাবে বিশেষ সংযম ছিল বলিয়াই কথিত আছে। তাই, সংশয় হয়, তিনি নিজে এই রাবণের সিঁড়িটি দেখিলে হয়তো বা মনে মনে সংকুচিতই হইতেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE