ম্যাক্সমুলার সাহেব যখন সংস্কৃত সাহিত্যের নবজাগরণের যুগ হিসাবে গুপ্তযুগের ইতিহাস ঘাঁটিতেছিলেন, জার্মান ভারততত্ত্ববিদ কি কল্পনাও করিয়াছিলেন যে, এই দেশে মাত্র দেড় শতক পরে তাঁহার দেশের ভাষাটি সংস্কৃতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া দাঁড়াইবে? ঊনবিংশ শতকে ম্যাক্সমুলার তো ভাবিতে পারিতেনই না, একুশ শতকের প্রথম দশকেও ইহা কল্পনা করা খুবই দুষ্কর ছিল। অথচ দেখা গেল, ২০১৪ সালে সংস্কৃত ও জার্মান শিক্ষা-রণক্ষেত্রে পরস্পর যুধ্যমান। ব্যাপার এতই গুরুতর যে বিদেশে আন্তর্জাতিক বৈঠকে বসিয়াও জার্মান চ্যান্সেলর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভারতে জার্মান ভাষার অনিশ্চিত ভবিষ্যত্ সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করিতে ভোলেন নাই, ‘একটু দেখিতে’ অনুরোধ জানাইয়াছেন। নরেন্দ্র মোদীও আশ্বাস দিয়াছেন, ‘দেখিবেন’। হয়তো কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে তৃতীয় ভাষা হিসাবে জার্মানের দিন ফুরাইয়া সংস্কৃতের জায়গা হইলেও জার্মানকে চতুর্থ বা পঞ্চম ঐচ্ছিক ভাষা রূপে রাখা হইবে।
মার্কেল তাহাতে তুষ্ট হইলেও মোদীর নিজের দেশের অভিভাবকরা সে কথা মানিবেন কি? কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের ভাষাশিক্ষা বিষয়ে এই সিদ্ধান্ত মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক অনুমোদন করামাত্র ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মায়েরা হাহাকার শুরু করিয়াছেন, জার্মান ভাষা শিক্ষা তাঁহাদের সন্তানদের সামনে বিশ্বায়িত হইবার যে অমেয় সুযোগ আনিয়াছিল, তাহা হারাইবার দুঃখে দিশাহারা হইতেছেন। বৃহত্ বিশ্বময় ইংরেজির পর জার্মান ভাষার গুরুত্বই সর্বাধিক কি না, ইহা লইয়া বিতর্ক চলিতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বীকার করিতেই হইবে যে ফরাসি বা স্পেনীয় বা আরবি বা ফারসিও একই যুক্তিতে অনেক দূর লড়িবার শক্তি রাখে। মূল কথাটি আলাদা। ভারতীয় ছাত্রছাত্রীর যদি জার্মান শিখিবার দরকার হয়, তাহা ঐচ্ছিক ভিত্তিতে রাখাই যাইতে পারে, আবশ্যিক করিবার দরকার কী। সকল ভারতীয় শিশুর পক্ষে জরুরি হইয়া উঠিবার মতো গুরুত্ব জার্মান ভাষার নাই, মার্কেলও মানিবেন।
ইন্দিরা গাঁধীর আমলে যখন তিন-ভাষা শিক্ষার সিদ্ধান্ত হয়, তখন প্রধান লক্ষ্য ছিল ইংরেজির সহিত দেশীয় ভাষাশিক্ষার ভিত আরও মজবুত করা। বিদেশি ভাষা যত প্রয়োজনীয়ই হউক না কেন, বিদ্যালয় স্তরে দুইটি বিদেশি ভাষার জায়গা করিয়া দিবার অবকাশ বহু-ভাষাভাষী, বহু-সংস্কৃতিমান দেশ ভারতের নাই। ইংরেজি, (হিন্দি বা অন্য) কোনও আঞ্চলিক ভাষা এবং সংস্কৃত, এই তিন ভাষার কথাই ভাবা হইয়াছিল, ইউ পি এ সরকার-কৃত সংশোধনীর আগে পর্যন্ত তাহাই প্রচলিত ছিল। প্রশ্ন উঠিবে, সংস্কৃত কেন? উত্তর: স্বভাবত। বিদ্যালয় স্তরে পাঠ্য অধিকাংশ ভারতীয় ভাষার সহিত সংস্কৃতের গভীর যোগ। বাংলার মতো আঞ্চলিক ভাষার সহিত শব্দ-পদ-বাক্য রীতিতে সংস্কৃত শিক্ষার বিপুল নৈকট্য। তদুপরি, সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ-কাঠামো বিশেষ ভাবে আঙ্কিক চরিত্রের, তাই ইহার শিক্ষা বিশ্লেষণী ক্ষমতা বাড়ায়। বিজেপির সংস্কৃত-নীতির পিছনে সংকীর্ণ লক্ষ্য থাকিলে তাহার প্রতিরোধ দরকার, কিন্তু সেই যুক্তিতে সংস্কৃত শিক্ষার গুরুত্ব অস্বীকার করা মূর্খতা। রাইনল্যান্ড হইতে আসিয়া ম্যাক্সমুলারও বুঝিয়াছিলেন, আধুনিক ভারতীয় ভাষা-সভ্যতার জন্যই সংস্কৃত নামক প্রবহমান ভাষাটির চর্চা না করিলে গতি নাই। আধুনিক ভারতীয় অভিভাবক-সমাজ যেহেতু বিশ্ব-ফ্যাশনের পূজাটুকুতেই আগ্রহী, তাঁহারা বিশ্বায়নের শিকড়ের জোরটি বুঝিতে নারাজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy