কে ন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন দফতর একটি নিশ্চিত লঙ্কাপুরী। যিনিই সেখানে যান, যথেচ্ছাচারের শেষ কথা হইয়া ওঠেন। নেহরু-যুগের রাষ্ট্র-ভাবনার কল্যাণে যেহেতু এই দফতরটির অধীনে থাকে দেশজোড়া শিক্ষা-পরিসর, এবং তাহার সূত্রে এক সুবিশাল অংশের জনসাধারণের কাছে পৌঁছাইতে পারার অমিত সুযোগ, এই সরকারি দফতরটির কাণ্ডকারখানা চট করিয়া বিপজ্জনক হইয়া উঠিতে পারে। বিগত ইউপিএ জমানার মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী কপিল সিব্বলের গগনবিহারী যথেচ্ছাচার দেখিয়া মনে হইয়াছিল, ইহাকে অতিক্রম করা কঠিন। ভুল হইয়াছিল। বর্তমান এনডিএ সরকারের মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি দেড় বৎসর না পুরাইতেই তাঁহার পূর্বসূরিকে ছাপাইয়া গিয়াছেন। কর্তৃত্ববাদের সীমারেখাগুলি একটি একটি করিয়া তিনি অতিক্রম করিতেছেন। তাঁহার নবতম কীর্তি, শিক্ষকদের মাধ্যমে সরকারি বিমা নীতিগুলি দেশ জুড়িয়া প্রচার করিবার নির্দেশ। শিক্ষক দিবস সমাগত। শিক্ষকদের অনুপ্রাণিত করিতে তিনি নিয়মমাফিক বাণী বিতরণ করিতেছিলেন। সমাজের কাছে তাঁহাদের স্থানটি যে কত গুরুতর, তাহার রেখচিত্র তুলিয়া ধরিতেছিলেন। অতঃপর তাঁহার সংযোজন, শিক্ষকদের অতুলনীয় জনসংযোগের মাধ্যমে সরকারি বিমা নীতিগুলির গুণাবলি দিকে দিকে ছড়াইয়া পড়ুক, তাহাতে সমাজের কল্যাণ হইবে। কেন্দ্রীয় সরকারেরও যে কল্যাণ হইবে, এবং বিমা প্রকল্পগুলির নাম প্রধানমন্ত্রীর নামে হওয়ার দরুণ প্রধানমন্ত্রীরও যে সবিশেষ কল্যাণ হইবে, অত কথা স্বভাবতই তিনি বলেন নাই।
বিমার অমোঘ কল্যাণ-ডোরে শিক্ষক সমাজ ও বৃহত্তর জনসমাজকে বাঁধিবার এই নির্দেশের মধ্যে মাঝখান হইতে মারা পড়িয়াছে বেচারি শিক্ষকদের কল্যাণের বিষয়টি। আর যে কত দায়িত্ব তাঁহাদের লইতে হইবে, মন্ত্রীরাই জানেন। সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা এমনিতেই নিয়মিত ভিত্তিতে সরকারি কাজের ফাঁসে দিনযাপন করিতে করিতে উদব্যস্ত। নানাবিধ প্রশাসনিক কাজে তাঁহাদের হাত লাগাইতে হয়, মিড-ডে মিলের আয়োজনভার বহন করিতে হয়, ভোটের ব্যবস্থাপনায় ছোটাছুটি করিতে হয়, জনশুমারির জন্য দুয়ারে দুয়ারে ঘুরিতে হয়। ফুরসত মিলিলে পড়ানোর কাজটিও সময়ে-সময়ে করিতে হয়। এখন যুক্ত হইল বিমা বেচিবার কাজও। গত শিক্ষক দিবসের অভিভাষণে প্রধানমন্ত্রী মোদী আক্ষেপ করিয়াছিলেন, শিক্ষকতার পেশায় আসিবার ইচ্ছাটি ক্রমেই যেন সমাজের মধ্যে কমিয়া আসিতেছে। তাঁহার স্বহস্ত-নির্বাচিত মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীর নির্দেশই বুঝাইয়া দিল, এই দুর্ভাগ্যজনক হ্রাসের অন্যতম কারণটি কী। শিক্ষকতা যদি সরকারের কিঙ্করতার আর এক নাম হয়, তাহা হইলে এই পেশাকে স্বর্ণালি ভাবিবার কোনও কারণ আছে কি?
তবে মাত্রাছাড়া কর্তৃত্ববাদ ছাড়াও একটি গভীরতর উদ্বেগের বিষয় আছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শিক্ষকদের যে সহজ অধিকারের মঞ্চে দাঁড়াইয়া আদেশ-নির্দেশ দিতে পারেন, তাহা হইতে স্পষ্ট, শিক্ষাক্ষেত্র আসলে রাষ্ট্রীয় রাজনীতির একটি অঙ্গাঙ্গি পরিসর। শিক্ষা যেন প্রথমত ও প্রধানত রাষ্ট্রের নিজস্ব সম্পদ নির্মাণের মাধ্যম। এই ছিদ্র ধরিয়াই অকাতর কর্তৃত্বপ্রবণতার কালসর্প যখন-তখন প্রবেশ করিতে পারে। ইহা কেবল কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষত্ব নয়, রাজ্যে রাজ্যেও এই ভাবনারই দাপাদাপি। বস্তুত ভারতীয় রাষ্ট্রের একটি বিশেষ চারিত্রলক্ষণ দাঁড়াইয়া গিয়াছে শিক্ষার উপর রাজনৈতিক কব্জা বসাইবার রীতিটি। সহজে এই রীতি হইতে উদ্ধারের আশা নাই। বরং ভারতীয় সমাজের অতি-রাজনৈতিকীকরণের অভিমুখটি হইতে মনে হয়, ইহা ক্রমশ আরও শক্তপোক্ত হইবে। স্মৃতি ইরানিরা উত্তরোত্তর আরও ভয়ঙ্করী হইবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy