মু খ্যমন্ত্রী বিরোধীদের দশ বৎসর চুপ করিয়া থাকিবার পরামর্শ দিয়াছিলেন। কথা না শুনিলে কী হইবে, জানান নাই। সিপিআইএম-এর প্রাক্তন বিধায়ক ধীরেন লেট মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শের মাহাত্ম্য টের পাইলেন। দলীয় জাঠায় যোগ দেওয়ার অপরাধে তাঁহাকে রক্তাক্ত অবস্থাতেই কান ধরিয়া উঠবোস করিতে হয়, এবং বলিতে হয়, তিনি আর সিপিআইএম করিবেন না। এই রাজ্যে বিরোধী রাজনীতি করিবার বিপদ আরও অনেকেই টের পাইতেছেন। পার্টি অফিসে আগুন জ্বালাইয়া, মিছিলে হামলা করিয়া বাহুবলীরা বুঝাইয়া দিয়াছেন, রাজ্য এখন কাহাদের দখলে। তবে, সৎ ভাবে স্বীকার করিলে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা বলিতেন, যাহা চলিতেছে, ফরাসি ভাষায় তাহাকে ‘দেজা ভু’ বলে। যাহা ঘটিতেছে, তাহা পূর্বেও ঘটিয়াছে, এই অনুভূতির নামই দেজা ভু। যখন লোকাল কমিটির নির্দেশ ভিন্ন গাছের পাতাটিও নড়িত না, তখনও শাসক আর বিরোধীদের সম্পর্ক এমনই ছিল। শুধু, ভূমিকা দুইটির কুশীলবদের অদলবদল হইয়া গিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গ যেখানে ছিল, সেখানেই আছে। আগে ছিল গড়বেতা-কেশপুর, এখন হইয়াছে নারায়ণগড়-পিংলা।
কিন্তু পূর্বেও এই কাণ্ড ঘটিয়াছে বলিয়া আজ তাহার পুনরাবৃত্তিতে দোষ নাই, কালীঘাটের হাজার ইচ্ছাতেও এমন যুক্তি মান্যতা পাইবে না। সহিষ্ণুতাই গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত, তাহা মুখ্যমন্ত্রী জানেন, নচেৎ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে তিনি গলা মিলাইবেন কেন? তবে, জানিলেই মানিতে হইবে, মুখ্যমন্ত্রী সম্ভবত তাহা মানেন না। ফলে, যখন তাঁহার দলের নেতারা সিপিআইএম-কে সামাজিক বয়কটের ডাক দেন, যখন ‘ঘরে ছেলে ঢুকাইয়া দেওয়া’র হুমকি দেন, যখন বিরোধীদের বিষধর সর্পের সহিত তুলনা করেন, তখন সস্নেহ প্রশ্রয় ভিন্ন তাঁহার নিকট আর কোনও প্রতিক্রিয়া মিলে না। বিরোধী মিছিলে দলীয় হামলাকে তাঁহার নিন্দার্হ মনে হইবে, সেই সম্ভাবনাও তীব্র নহে। রাজ্যে যে সন্ত্রাস চলিতেছে, তাহার প্রথম বলি গণতন্ত্র। শাসকদের নিকট রাজনীতির মূল কথা রাজ্যকে ‘বিরোধীশূন্য’ করা। সেই কাজ যে পথে হয়, তাহাই পন্থা।
‘বিরোধীশূন্য’ পশ্চিমবঙ্গ রচনা করিবার কাজে শাসকরা পুলিশের অকুণ্ঠ সহযোগিতা লাভ করিয়াছেন। বিরোধীদের আক্রান্ত হইতে দেখিলেও পুলিশ দূরে দাঁড়াইয়া থাকে। যে সাংবাদিকরা শাসকদলের ‘বিরোধী’, বিধাননগরে তাঁহারা মার খাইলেও পুলিশ টুঁ শব্দটি করে নাই। বঙ্গেশ্বরীর মন্দিরে মেরুদণ্ড ভেট চড়াইবার পর অবশ্য এমন আচরণই প্রত্যাশিত। পুলিশ যে প্রশাসনের অংশ, শাসক দলের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী নহে, পশ্চিমবঙ্গে দাঁড়াইয়া তাহা বুঝিবার কোনও উপায় নাই। তবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্মরণ করিতে পারেন, এখন যেমন কালীঘাটের আজ্ঞা বহন করাই পুলিশের একমাত্র কাজ, এক সময় পুলিশবাহিনীর উপর আলিমুদ্দিন স্ট্রিটেরও একই নিয়ন্ত্রণ ছিল। কয়েক বৎসর পূর্বেও যাঁহাদের অঙ্গুলিহেলনে পুলিশ উঠিত-বসিত, আজ তাঁহাদেরই আক্রান্ত হইতে দেখিয়া দূরে দাঁড়াইয়া মুচকি হাসে। অর্থাৎ, পুলিশের আনুগত্য রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতি। গণদেবতার অভিশাপে নবান্নের সিংহাসন টলিয়া গেলে কালীঘাটের সর্বাধিনায়িকাও আর পুলিশকে পার্শ্বে পাইবেন না। পুলিশের মেরুদণ্ডটি অক্ষত রাখিলে এই বিপদ হইত না। বাহিনীর আত্মসম্মান চার আনায় বিকাইয়া না গেলে হয়তো নিরপেক্ষতা বজায় থাকিত। পুলিশ হয়তো গণতন্ত্রের লজ্জারক্ষায় কিঞ্চিৎ সক্রিয় হইত। বামপন্থীরাও সাময়িক সুবিধার লোভে এই দীর্ঘমেয়াদি সত্যটিকে ভুলিয়াছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ভুলিয়াছেন। বামপন্থীরা আজ সেই ভুলের দাম চুকাইতেছেন। সময় হয়তো বঙ্গেশ্বরীরও পরীক্ষা লইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy