জমি ও পেনশন
‘দাম বাড়লেই চাষি জমি ছাড়বেন তো?’ শিরোনামে এই পত্রলেখকের একটি চিঠি (সম্পাদক সমীপেষু, ১৬-২) প্রকাশিত হয়েছিল। পেনশনভিত্তিক জমি অধিগ্রহণ কী ভাবে এই রাজ্যের জন্য আদর্শ হতে পারে, চিঠিটিতে সে আলোচনা করা হয়েছিল। ওই চিঠির স্বল্প পরিসরে যে আলোচনা করা যায়নি তা হল, জমিদাতা চাষির কাছে পেনশন প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা কী রকম। আজ যখন জমি অধিগ্রহণের অধ্যাদেশ নিয়ে সংসদ-সহ দেশের সর্বত্র বিতর্ক চলছে তখন বিকল্প এই পেনশন প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আলোচনা নিঃসন্দেহে যুক্তিযুক্ত।
প্রসঙ্গত, প্রস্তাবিত পেনশন প্রকল্প চাষির বাত্সরিক আয়কে বর্তমানের তুলনায় কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে এবং আপত্কালে হাতে এককালীন বেশি পরিমাণ টাকা পাওয়ার সুযোগ দেয় উপরন্তু অধিগ্রহণের পরেও জমির ভবিষ্যত্ লভ্যাংশ থেকে চাষিকে বঞ্চিত করে না। “এমন উদার প্রকল্প আপনার কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য?” এই প্রশ্নের উত্তরে আরামবাগ ব্লকের মুণ্ডেশ্বরী নদীর ধারে কৃষ্ণপুর গ্রামের এক বর্ধিষ্ণু চাষির বক্তব্য, ‘বেশি টাকার পেনশনের লোভে জমি ছেড়ে শেষ কালে চাষির অবস্থা সেই ইস্কুলমাস্টারের মতো হবে না তো? যাকে পেনশনের টাকা পেতে অনেকগুলো জুতোর সুখতলা খুইয়ে ফেলতে হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, সরকার বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, জমি কিন্তু তা করে না।’
খানাকুুল ব্লকের মোস্তাফাপুর (উত্তর) গ্রামের এক চাষির বক্তব্য, ‘আজ হঠাত্ টাকার দরকারে জমি বন্ধক দিতে বা বেচতে চাইলে তত্ক্ষণাত্ বন্ধকের কারবারি বা জমির ক্রেতা টাকার থলি নিয়ে আমার বাড়ি ছুটে আসবে। কাল সরকারকে জমি দিয়ে পেনশন প্রকল্পে যাওয়ার পর পেনশন বন্ধক রেখে টাকা পেতে তো কালঘাম ছুটে যাবে। মেয়ের বিয়ের জন্য চাওয়া টাকা পেতে মেয়ের ঘরের নাতির মুখেভাতের সময় এসে যাবে। কোন ভরসায় জমি ছাড়ব বলতে পারেন?’ একই গ্রামের অপর এক চাষির বক্তব্য, ‘বিপদের দিনে টাকা পেতে সরকারি বাবুদের টেবিলের তলা দিয়ে কাটমানি দিতে হবে না তো?’
আরামবাগ ব্লকেই পূর্ব কেশবপুর গ্রামের এক চাষির গলায় সম্পূর্ণ ভিন্ন সুর। ‘সরকার যদি সত্যিই চাষ থেকে আয়ের বেশি পেনশন দেয় আর দরকারে পেনশন বিক্রির সুযোগ থাকে, তা হলে আমার মতো চাষির জমি ছেড়ে দিলে লাভ বই ক্ষতি নেই। আজকাল শুধুমাত্র চাষের নেশায় চাষ করি। লাভ দূরে থাকুক, লোকসান না-হলেই বেঁচে যাই। সার, বীজ, ওষুধের দাম আকাশছোঁয়া অথচ ফসল ওঠার পরে দাম পাই না। চাষের কাজে ভাল মজুর পাওয়াও সমস্যা। তাই জমিতে নিজে খাটতে না-পারলে মাঝে মাঝে মনে হয়, যেন চাষ না-করাই ভাল। তবু ওই যে বললাম, নেশায় চাষ করি।’
উল্লিখিত চাষিদের বাড়ির স্কুলপাশ বা কলেজ পড়ুয়া ছেলেপুলেরা আলোচ্য পেনশন প্রকল্পের বড় সমর্থক। তারা চাষবাসকে জীবিকা হিসাবে নিতে চায় না। এমনকী কোনও চাষিই চায় না তার ছেলে চাষি হয়েই জীবন কাটাক। মোটের উপর চাষিদের সঙ্গে কথা বলে সামান্য এই গবেষকের মনে হল, এককালীন টাকার বিনিময়ে জমি ছাড়ার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দক্ষিণবঙ্গের চাষিরা যতটা খড়্গহস্ত উল্লিখিত পেনশন প্রকল্পের বিরুদ্ধে কিন্তু ততটা খড়্গহস্ত নয়। যদিও দ্বিতীয় এই ব্যবস্থা সত্যিই তাঁদের স্বার্থ সুরক্ষিত করবে কি না সে বিষয়ে তাঁরা কিছুটা সন্দিহান। তাঁদের সন্দেহ যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। কিন্তু এটা বিস্ময়ের, কোনও রাজনৈতিক দলই কেন জমি অর্ডিন্যান্সের বিরোধিতায় বিকল্প হিসাবে পেনশন প্রকল্পের দাবি তুলছে না। যেহেতু স্বল্পশিক্ষিত স্বল্পবিত্ত চাষি বড় অঙ্কের টাকা দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখতে পারেন না, নানান বিচিত্র উপায়ে তা খরচ হয়ে যায়, সেহেতু তাঁদের সুরক্ষার স্বার্থেই প্রয়োজন সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন এক ন্যায্য পেনশন প্রকল্প। বামপন্থীরাও এ দাবি না-তোলায় বোধ হচ্ছে তাঁরাও আর ‘কৃষাণের জীবনের শরিক’ হতে চান না। অথচ যে সময় চাষ থেকে লাভ তলানিতে, চাষির ছেলে চাষ করতে চায় না, বেকার সমস্যা ভয়াবহ, দ্রুত শিল্পায়ন জরুরি সে সময় রাজ্য চাষির জন্য ‘জমির বিনিময়ে পেনশন চাই’ এই দাবি বামপন্থীদের পায়ের তলাকার হারিয়ে যাওয়া জমিটাকে ফিরিয়ে দিলেও দিতে পারে কিন্তু।
মানসেন্দু কুণ্ডু। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান্টা বারবারা এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, শিবপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy